Saturday 15 April 2017

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত বনাম বাতিল ফিরক্বাহ :




(
اهل السنة والجماعة و مقابلها الفرق الباطلة وعقيدتها الفاسدة )
প্রেক্ষিত : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও ভ্রান্ত আক্বিদাসমূহ :

প্রসঙ্গ কথা :
ঈমান হচ্ছে ইসলামের মূলভিত্তি । ঈমানের বহু শাখা প্রশাখা রয়েছে । তন্মধ্যে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত- এই তিনটি ঈমানের মৌলিক শাখা । ঈমানের অন্যান্য শাখাগুলো এই তিনটি মৌল শাখা হতে উৎসারিত । উল্লেখ্য যে, তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত এই তিনটি হচ্ছে আকাইদ শাস্ত্রের মূল বিষয়বস্তু ।
আক্বাঈদ শাস্ত্রের উদ্দেশ্য :
আকাঈদ শাস্ত্রের উদ্দেশ্য হলো- ঈমান দূরস্ত করা । ঈমান সংক্রান্ত প্রত্যেকটি বিষয়কে কুরআন-সূন্নাহ, সালফে সালেহীনের ব্যাখ্যা , দার্শনিক বিচার বিশ্লেষণ ও যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে দৃঢ় এবং মজবুতরূপে প্রতিষ্ঠিত করা । ইহা হতে যাবতীয় ভ্রান্তি, সন্দেহ এবং জটিলতা দূর করত: মুমিনের হৃদয়ে স্বচ্ছ-পরিষ্কার ধারণা ও বিশ্বাস সৃষ্টি করা ।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের পরিচিতি :
আহলুস সুন্নাহর আভিধানিক অর্থ সুন্নাহপন্থী । অর্থাৎ- রাসুলে কারীম ( সা: ) এবং সাহাবীগণের পদাংক অনুসারীগণই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত নামে পরিচিত । যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, কর্ম এবং যাবতীয় আচার অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু নাবী কারীম ( সা: ) এর বিশুদ্ধ সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কিরামের বিশুদ্ধ পবিত্র আচরণ । এ পর্যায়ে নিম্নোক্ত আয়াতে কারীমা ও হাদীসকে ভিত্তি করে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যায় । 
قال الله سبحانه وتعا لى :
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ 
অনুবাদ : ( আর হে নবী বলে দিন ! ) নিশ্চয়ই আমার প্রদর্শিত পথই হচ্ছে সরল সঠিক পথ ; অতএব তোমরা সেই পথেরই অনুসরণ করো , ( আমার প্রদর্শিত পথ ও মত পরিহার করে ) তোমরা অন্য পথের অনুসরণ করো না ; অন্যথায় তোমরা সরল সঠিক পথ থেকে
লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে যাবে । ( সূরাহ আনআম-আয়াত =১৫৩ )
এ পযায়ে একটি হাদীস বর্ণিত হচ্ছে :
عن عبد الله بن عمر ( رض ) قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : " وان بنى اسرائيل تفرقت على ثنتين و سبعين ملة ، وتفترق امتى على ثلاث و سبعين ملة، كلهم فى النار الا واحدة ، قالوا : من هى يا رسول الله ( ص ) قال ما انا عليه واصحابى _ ( رواه الترمذى – رقم الحديث= )2641 (
অনুবাদ : আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ( রা: ) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন: রাসূল ( সা : ) বলেছেন : নিশ্চয়ই বনি ইসরাঈল সম্প্রদায় বায়াত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে কিন্তু আমার উম্মাত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে । একটি দল ছাড়া সব দলই জাহান্নামে প্রবেশ করবে ।
সাহাবাগণ আরজ করলেন হে আল্লাহর রাসূল ! ফেরক্বায়ে নাজিয়াহ্তথা মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি ? উত্তরে রাসূল ( সা: ) বল্লেন : আমি এবং আমার সাহাবায়ে কিরামের যারা অনুসরণ করবে, তারাই হলো মুক্তিপ্রাপ্ত দল । ( তিরমিজী = হাদীস নং- ২৬৪১ )
আলোচ্চ আয়াতে কারিমা ও হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, একমাত্র রাসূল ( সা: ) ও তাঁর সাহাবায়ে কিরামের অনুসারীবৃন্দই হলো মুক্তিপ্রাপ্ত দল । এরাই মূলত: আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত নামে পরিচিত । এছড়া বাকি সব দল فرقة ضلالة " তথা ভ্রান্ত দল ।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ :
পবিত্র ক্বুরআন মাজিদ ও হাদীসে ইসলামের আক্বিদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়গুলো যুক্তিপ্রমান সহকারেই আলোচিত হয়েছে । সাহাবায়ে কিরামের ঈমান ছিল ইস্পাত কঠিন দৃঢ় । তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত সম্পর্কে তাঁদের বিশ্বাস ছিল নজির বিহীন মজবুত । এ বিষয়ে তাদের মনে কোন প্রকার সংসয় স্থান পায়নি । কোন বিষয় বুঝে উঠতে সামান্যতম অসুবিধা দেখা দিলেই তাঁরা তা নবী কারীম ( সা: ) এর নিকট পেশ করতেন এবং রাসূল ( সা: ) তার ফায়সালা দিতেন । সুতরাং ঈমান-আক্বিদার ব্যাপারে কোন জটিলতার সৃষ্টি হতো না । এ বিষয় নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ, দার্শনিক ব্যাখ্যা ও যুক্তি তর্কের কোন প্রয়োজন অনুভূত হতো না ।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ইসলাম যতদিন আরব জাহানে সীমাবদ্ধ ছিল এবং মুসলমানগণ যতদিন কোন অনারব জাতির সংস্পর্শে আসেনি, ততদিন পর্যন্ত ঈমান- আক্বিদার এই বিশুদ্ধতা অক্ষুন্ন ছিল । অত:পর যখন ইসলাম আরব জাহানের গন্ডির সীমানা পেরিয়ে অনারব ভুমিতে প্রবেশ করলো এবং মুসলমানগণ বিশ্বের অন্যান্য জাতির চিন্তাধারা, ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা সংস্কৃতির সংস্পর্শে এলো, তখন হতেই মুসলমানদের মাঝে ঈমান-আক্বিদার মধ্যে নানা প্রকার ভ্রান্ত ধারনার জন্ম হতে লাগলো । 
আব্বাসীয় খেলাফতকালে রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বের বিভিন্ন জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত বই-পুস্তক বিশেষ করে গ্রীক ও পারস্য দর্শনের গ্রন্থরাজি আরবী ভাষায় অনুদিত হয় । ফলে মুসলমানগণ এই সমস্ত বিজাতীয় দর্শন সন্বন্ধে জ্ঞান লাভের সুযোগ পায় । এ সকল দর্শন অধ্যয়ন করে তারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে । এমনকি তাদের একশ্রেণীর লোক জীবনের যাবতীয় কাজ কর্মকেই দার্শনিক যুক্তি প্রমানের মাপকাঠিতে বিচার বিশ্লেষণ করতে আরম্ভ করে । ফলে মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসে নানা রকম জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয় । তদুপরি আব্বাসীয় খলিফাগণ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনসাধারণকে দর্শন ও ধর্মতত্ত সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ের উপর মুক্ত আলোচনা করার সুযোগ দান করেন । এই সুযোগে তারা অত্যন্ত চতুরতার সাথে নানা ধরণের ভ্রান্ত আক্বিদার বীজ বপন করে । তারা যে কোন বিষয়ের সমাধান ক্বুরআন-সুন্নাহ থেকে গ্রহণ না করে মস্তিষ্ক প্রসূত জ্ঞান ও যুক্তি প্রমানের মাপকাঠিতে বিচার বিশ্লেষণ করতে লাগলো । ফলে তারা সরল সঠিক পথ ( সীরাতুল মুস্তাক্বীম ) থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেল । তাদের নিজস্ব মনগড়া চিন্তাধারার ভিত্তিতে বিভিন্ন ফেরক্বাহ বা দলের উদ্ভব হতে লাগলো । ভ্রান্ত আক্বিদায় প্রভাবিত হয়ে মানুষ পথভ্রান্ত হতে লাগলো । 
মুসলমানদের ঈমান-আক্বিদার হেফাজতের স্বার্থে হক্বানী ওললামায়ে কিরাম ক্বুরআন-সুন্নাহ ও অকাট্য যুক্তি প্রমানের আলোকে ইলমে কালাম নামক স্বতন্ত্র একটি শাস্ত্র রচনা করতে ব্রতী হন । ওলামায়ে কিরাম কালাম শাস্ত্র রচনা করত: বাতিল পন্থীদের দাতভাঙ্গা জবাব প্রদান করেন । 
ইলমুল কালামের উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে পরবর্তি যুগে ইমাম গাজ্জালী , ইমাম রাজি, দার্শনিক রূমী, ইমাম আশআরী, ইমাম মাতরুদী প্রমূখ বিশ্ববরেন্য জ্ঞানতাপসগণ ক্বুরআন-সুন্নাহ, দর্শন ও বিজ্ঞানভিত্তিক এবং বিবেক সম্মত যুক্তিপ্রমান দ্বারা ইসলামী আক্বাঈদ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর যথার্ততা প্রমান করেন । তারা ভ্রান্ত মতবাদসমূহ খন্ডন করত: আক্বঈদ শাস্ত্রকে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন । তাঁদের অক্লান্ত চেষ্টা ও সাধনার ফলেই ইলমুল কালাম একটি সমপূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং সর্বসাধারণের নিকট তা গ্রহণযোগ্য হয় ।তারা বহুসংখ্যক গ্রন্থ রচনা করত: ইলমুল কালামকে জনপ্রিয় করে তোলেন ।

বিভিন্ন ফিরক্বাহ্ বা সম্প্রদায়ের আবির্ভাব :
বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ( সা: ) এর তিরোধানের কয়েক শতাব্দীর মধ্যে ইসলামে যে সব সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে , তন্মধ্যে খারিজী,শিয়া, মুতাযিলা, মুরজিয়া, জাবরিয়া, ক্বাদরিয়া, আশায়েরা, জুহুমিয়া, বারাহিমা সম্প্রদায় অন্যতম । নিম্নে এসব সম্প্রদায়ের উদ্ভব, বিকাশ ও মতবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হচ্ছে ।
০১. খারেজী সম্প্রদায়
নামকরণ :
খারিজী শব্দটির অর্থ দলত্যাগকারী । নির্ভেজাল তাওহীদের অনুসারী উম্মাতে মুসলিমার দল ত্যাগ করায় খারিজীগণ উক্ত নামে অভিহিত হয় ।
খারিজী সম্প্রদায়ের উৎপত্তি :
প্রথমদিকে এই দলটি ছিল আলী ( রা: ) এর সমর্থক দল । ৬৫৭ খৃ: সিফফিন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে আলী ( রা: ) এর পক্ষে আবু মুসা আশআরী ( রা: ) এবং মুয়াবিয়ার পক্ষে আমর উবনুল আস ( রা: ) শালিশদার নিযুক্ত হন । আমর ইবনুল আস ( রা: ) এর চক্রান্তে মুয়াবিয়ার অনুকুলে এবং আলী ( রা: ) এর প্রতিকুলে যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় । শান্তিকামী খলিফা আলী ( রা: ) এই মিমাংসা মেনে নেন । এতে আলী ( রা: ) পক্ষে বার হাজার মুজাহিদ ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর দল হতে বের হয়ে যায় । ইসলামের ইতিহাসে এরাই খারিজী বা দলত্যাগকারী সম্প্রদায় বলে পরিচিত ।
খারিজী সম্প্রদায়ের মতবাদ :
এ দলটি একটি চরমপন্থী দল । এরা বিভিন্ন ব্যাপারে চরমপন্থা মতবাদ প্রচার করেন । 
তারা বলেন- ঈমানের দুটো রুকন । একটি হলো অন্তরে বিশ্বাস আর অপরটি হলো আমল । অতএব অন্তরে বিশ্বাস থাকা সত্তেও কেউ যদি ফরজ আমল পরিত্যাগ করে , তবে সে আর মুমিন থাকে না, কাফির হয়ে যায় । আবার অন্তরে বিশ্বাস রেখেও কেউ যদি কাবীরাহ গুনাহ করে , সেও মুমিন থাকে না,কাফির হয়ে যায় । তারা আরও বলেন- জালিম ইমাম বা শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা প্রত্যেক মুমিনের উপর ওয়াজিব । সুতরাং কোন জালিম শাসককে সমর্থনকারীও মুমিন থাকতে পারে না, কাফির হয়ে যায় । অতএব মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধের ফতোয়া দেওয়ার জন্য তারা আবু মুসা আশআরী ( রা: ) এবং আমর ইবনু আস ( রা: ) কে কাফির বলে ঘোষণা করে । আর এই অবৈধ মিমাংসা মেনে নেওয়ার জন্য তারা আলী ( রা: ) এবং তাঁর সমর্থনকারী সকলকেই কাফির বলে ফতোয়া দিয়ে বসে । 
চরমপন্থী খারিজীরা কোন ফরজ আমল পরিত্যাগ অথবা কোন কাবীরাহ গুনাহকারীকে শুধু কাফির বলেই ক্ষান্ত হননি বরং তাদেরকে হত্যা করাও মুমিনদের জন্য ওয়াজিব কাজ বলে ঘোষণা করেন ।

খারিজী সমপ্রদায়ের উথ্থান পতনের ইতিহাস :
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, খারিজী একটি উগ্রপন্থী সম্প্রদায়ের নাম । খারিজীরা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে আলী ( রা: ) এর বিরুদ্ধে প্রচারনা চালাতে লাগলো এবং জনসাধারণকে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ কতে লাগলো । তারা লুটতারাজসহ বিভিন্ন প্রকার নাশকতামূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে রাষ্ট্রে বিশৃংখলা সৃষ্টির পায়তারা চালাতে লাগলো । তাদেরকে দমন করার মানসে আলী ( রা: ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করলেন এবং নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারিজীদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু ওয়াহাবসহ বহুসংখ্যক খারিজী নিহত হলো । এতে খারিজীরা অতিশয় ক্রধান্বিত হয়ে আলী ( রা: ) , মুয়াবিয়া ও তাঁর উপদেষ্টা সিরিয়ার শাসনকর্তা আমরকে ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করত: তিনজনকেই হত্যা করার জন্য বদ্ধপরিকর হলো । মুয়াবিয়া ও আমর কোন রকমে বেঁচে গেলেও আলী ( রা: ) আততায়ী আব্দুর রহমান ইবনু মুলজিমের হস্তে নিহত হন । আলী ( রা: ) এর মৃত্যুর পর খারিজীরা উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো । উমাইয়ারা তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন । এরপর তারা নিরস্ত্র না হয়ে আব্বাসীয়দের সহিত যোগদান করে উমাইয়াদের পতন ঘটানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠে । আব্বাসীয়রা খেলাফত প্রাপ্ত হলে খারিজীরা তাদের বিরুদ্ধে বিরোধিতা শুরু করে দিল এবং মেসোপটোমিয়া , পূর্ব আরব ও উত্তর আফ্রিকার উপকুল ভাগে অশান্তি সৃষ্টি করতে লাগলো । অবশেষে মিশরের ফাতেমীয় শাসকগণ খারেজীদের শক্তি সমূলে ধ্বংস করে । পরিশেষে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে খারিজীগণ উগ্ররাজনৈতিক মতবাদ পরিত্যাগ করে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে অবস্থান নেয় ।
০২. শিয়া সম্প্রদায় :
নামকরণ ও পরিচিতি :
শিয়া অর্থ অনুসারী বা দল । এটা শিয়াতু আলী কথাটির সংক্ষিপ্ত রূপ । শিয়াতু আলী অর্থ আলীর দল । । হযরত আলী ( রা: ) এবং তার বংশধরদের সমর্থনকারী দলটিই এই নামে অভিহিত ।
উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :
খিলাফাত ও ইমামাতকে কেন্দ্র করে শিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব । খিলাফত প্রশ্নে শিয়াগণ হযরত আলী ( রা: ) কে সকল খলিফার উর্ধ্বে প্রাধান্য দিত । নবী কারীম ( সা: ) এর মৃত্যুর পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক ( রা: ) এর ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হলে শিয়াগণ এতে অসন্তুষ্ট হয় । তাদের মতবাদ হলো হযরত আলী ( রা: ) নবীর জামাতা এবং রাসূল ( সা: ) এর ঘরেই তিনি লালিত পালিত হন । সুতরাং তিনিই খেলাফতের প্রকৃত হকদার । তারা তাদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আবুবকর ও উমার ( রা: ) এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ পেশ করে । তাদের মতে রাসূল ( সা: ) নাকি মৃত্যু শয্যায় শয়নকালে আবুবকর ও উমার ( রা: ) কে আহবান করে একখানা অসিয়াতনামা লিখতে বলেন । যে অসিয়াতনামায় নাকি আলী ( রা: ) কে খিলাফত প্রদানের নির্দেশ ছিল । কিন্তু আবুবকর ও উমার ( রা; ) নাকি সেই অসিয়াতনামা গোপন করত: কৌশলে খিলাফতের পদ গ্রহণ করেন । এজন্য শিয়াগণ আবুবকর ও উমার ( রা: ) কে বিশ্বাস ঘাতক এবং কাফির হিসেবে ফতোয়া প্রদান করে । আবুবকর সিদ্দিক ( রা: ) এর মৃত্যুর পর উমার ( রা; ) খলিফা নির্বাচিত হলে শিয়ারা আর ও ক্ষুব্ধ হয় । উমার ( রা: ) এর মৃত্যুর পর ওসমান ( রা: ) খলিফা নির্বাচিত হলে শিয়াদের অস্তুষ্টি চরমে পৌছে । কাজেই বলতে গেলে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় হতে শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হতে থাকে । ওসমানের শাসনামলে আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা আলী (রা:)এর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে । সে প্রকাশ্যে ওসমানের বিরূদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও অন্যায় অবিচারের অভিযোগ আনয়ন করে । তাঁরই প্ররোরচনায় ওসমান ( রা: ) ঘাতকের হাতে নিহত হন । ইবনু সাবার গঠিত দলই আলী (রা: ) কে খিলাফত পদে অধিষ্ঠিত করে ।

শিয়াদের ধর্মীয় মতবাদ :
শিয়াদের মতে- নবী কারীম ( সা: ) এর ইন্তেকালের পর খিলাফত লাভের ব্যাপারে সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি হলেন হযরত আলী ( রা: ) এবং তাঁর বংশধরগণ । কেননা রক্তের সম্পর্কের দিক দিয়ে হযরত আলী ( রা: ) হলেন নবী কারীম ( সা; ) এর নিকটতম আত্মীয় । তিনি রাসূল ( সা: ) এর চাচাতো ভাই ও জামাতা । রাসূল ( সা: ) এর গৃহেই তিনি লালিত পালিত হন । কনিষ্ঠদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন । জ্ঞান-বুদ্ধি ও শৌর্যবীর্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ । সুতরাং- তাদের মতে একমাত্র আলীই রাসূল ( সা: ) এর ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী এবং খিলাফত তাঁরই প্রাপ্য । শুধুমাত্র তারই বংশধরদের মধ্য হতে হবে ইমাম, অন্য কোন বংশের লোক ইমাম হতে পারবে না । ইহাই হলো শিয়া মতবাদের সর্বপ্রধান মূলনীতি এবং কেন্দ্রবিন্দু । 
শিয়াগণ বলেন : আবুবকর , ওমর ও ওসমান ( রা; ) হযরত আলী ( রা: ) কে তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করত: খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন । অত:পর উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাগণও অবৈধভাবে আলী ( রা: ) এর বংশধরদের খিলাফত হতে বঞ্চিত করে বলপূর্বক সিংহাসন দখল করে রাখেন । আলী ( রা: ) এর প্রতি শিয়া সম্প্রদায়ের এত বেশি শ্রদ্ধা ছিল যে, কালিমা তাইয়েবা لا اله الاالله محمد رسول الله এর সহিত আলিউন নাবিউল্লাহ কথাটি সংযোজিত করে থাকে । 
শিয়ারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী । তারা মুহাম্মাদ ( সা: ) কে আল্লাহর নবী হিসেবে বিশ্বাস করে । পবিত্র কুরআনের প্রতি তাদের বিশ্বাস রয়েছে ।কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, উগ্রপন্থী শিয়াদের একটি গ্রুপ একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলে যে, “ আল্লাহর বাণী প্রকৃতপক্ষে হযরত আলীর উপরই অবতীর্ণ হয়, কিন্তু জিব্রাঈল নাকি ভুল করে মুহাম্মাদ ( সা: ) এর উপর অবতীর্ণ করেন । এজন্য তারা জিব্রাঈলকে বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে ফতোয়া দিয়ে থাকে ।
শিয়াদের মতানুসারে যিনি ইমাম হবেন তিনি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ নূরপ্রাপ্ত এবং আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান । তিনি রাসূল ( সা: ) হতে সরাসরি সেই নূর ও আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করেছেন । তাদের মতে- হযরত আলী ( রা: ) যেহেতু মুসলিম বিশ্বের ইমাম, তাই তিনি সরাসরি রাসূল ( সা: ) এর নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই নূর প্রাপ্ত হন । তারপর হযরত আলী ( রা: ) এর বংশধরগণ বংশ পরম্পরায় এই নূর লাভ করে এসেছেন । তাদের মতে এই ওহী আলোকপ্রাপ্ত ইমামগণ সকলেই নিষ্পাপ, অভ্রান্ত এবং যাবতীয় দোষত্রুটি হতে মুক্ত এবং পবিত্র । তারাই একমাত্র ইমাম হওয়ার যোগ্য , আর কেউ নয় । 
শিয়াগণ বিশ্বাস করে যে, হযরত আলী ( রা: ) এর বংশধরগণই পুরুষানুক্রমে পরপর ইমাম হবেন এবং এই বংশের সর্বশেষ ইমাম লোকচক্ষুর অন্তরালে আত্মগোপন করে রয়েছেন । তিনি জীবিতই আছেন । পৃথিবী যখন পাপাচারে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে, তখন সেই লুকায়িত ইমাম লোকসমাজে মাহদি রূপে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করবেন এবং পাপ নিমজ্জিত মানুষকে হেদায়েত দান করবেন । তবে এই আত্মগোপনকারী ইমাম কোন ব্যক্তি, এ বিষয়ে শিয়াদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে । এ পর্যায়ে তারা দু দলে বিভক্ত হয়েছে । এই দুই দলটি ইছনা আশারিয়া এবং সাবঈয়া নামে পরিচিত । আরবীতে ইছনা আশারিয়া কথাটির অর্থ হলো বার
অতএব শিয়া সম্প্রদায়ের যে দলটি বারজন ইমামকে শ্বিাস করে, তারাই ইছনা আশারিয়া 
নামে অভিহিত । আবার আরবী সাবউন শব্দের অর্থ সাত । শিয়াদের মধ্যে যারা সাত ইমামে বিশ্বাসী, তারাই সাবঈয়া নামে পরিচিত ।
ইছনা আশারিয়াদের মতে বারজন ইমামের তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হলো :
পুরুষানুক্রমিক অনুসারে ইছনা আশারিয়াদের মতে বারজন ইমাম হলেন : 
০১. হযরত আলী ( রা: ) ( মৃত ৬৬১ খৃ: ) ০২. হযরত হাসান ( রা: ) ( মৃত ৬৬৯ খৃ: ) 
০৩. হযরত হুসাইন ( রা: ) ( মৃত ৬৮০ খৃ : ) ০৪. জয়নুল আবেদীন ( মৃত ৭১২ খৃ: ) 
০৫. মুহাম্মাদ আল বাকির ( মৃত ৭৩১ খৃ: ) ০৬. জাফর আসসাদিক ( মৃত ৭৬৫ খৃ: ) 
০৭. মুসা আল কাজিম ( মৃত ৭৯৯ খৃ: ) ০৮. আলী আল রিযা ( মৃত ৮১৮ খৃ: ) 
০৯. মুহাম্মাদ আলজাওয়াদ ( মৃত ৮৩৫ খৃ : ) ১০. আলী আলহাদী ( মৃত ৮৬৮ খৃ: ) 
১১. হাসান আলআশকারী ( মৃত ৮৭৪ খৃ: ) ১২. মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আল মুনতাযার । 
উল্লেখ্য যে, হযরত আলী ( রা: ) বংশীয় এই বারজন, ইমামরূপে অভিষিক্ত । এদের সর্বশেষ বা দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু হাসান আত্মগোপন করে রয়েছেন । এ কারণেই তিনি মুনতাজার বা প্রতিক্ষিত বলে আখ্যায়িত ।
সাবঈয়াদের মতে সাত ইমামের তালিকা :
সাবঈয়াদের মতে সাত ইমাম হলেন যথাক্রমে  
০১. হযরত আলী ( রা: ) ০২. ইমাম হাসান ( রা: ) ০৩. ইমাম হুসাইন ( রা: ) ০৪. জয়নুল আবেদীন ০৫. মুহাম্মাদ আল বাকির ০৬. জাফর আসসাদিক ০৭.ইসমাঈল । 
সাবঈয়াদের মতে এই সাতজন আলী বংশীয় ইমাম বলে স্বীকৃত । তাদের মতে সর্বশেষ বা সপ্তম ইমাম আত্মগোপন করে রয়েছেন । অতএব দেখা যাচ্ছে যে, সাবঈয়াগণও ইছনা আশারিয়াদের মত প্রথম ছয়জন ইমামকে স্বীকার করে । কিন্তু ইছনা আশারিয়াদের সপ্তম ইমাম মুসা আলকাজিমকে সাবঈয়াগণ সপ্তম বলে মানেন নি । তাদের মতে সপ্তম ইমাম হলেন মুসা আলকাজিমের ভ্রাতা ঈসমাইল । এ জন্য সাবঈয়াগণ ইসমাঈলিয়া নামে পরিচিত ।
০৩. মুতাযিলা সম্প্রদায়
নামকরণ, পরিচিতি ও আবির্ভাব :

উগ্রপন্থি খারিজীদের উগ্র মতবাদ এবং নম্রপন্থি মুরজিয়াদের নমনীয় মতবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুতাযিলা সম্প্রদায়ের আবির্ভাব । এরা হলো স্বাধীন ও মুক্তবুদ্ধির সমর্থক । এরা যে কোন বিষয়কে যুক্তি ও মস্তিষ্কপ্রসূত জ্ঞানের আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে ।এই দলের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ইমাম হাসান আলবসরীর শিষ্য ওয়াসিল বিন আতা । মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে মুতাযিলা সম্প্রদায় বুদ্ধিবাদী সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত । মুতাযিলা সম্প্রদায়ের আবির্ভাব একটি ঘটনার সাথে জড়িত । ঘটনাটি নিম্নরূপ :
দামেস্কের জামে মসজিদের এক মজলিসে জনৈক ব্যক্তি হযরত ইমাম হাসান আলবসরীকে প্রশ্ন করলেন যে, ক্বাবীরাহ গুনাহকারী ব্যক্তি মুমিন না কাফির ? উত্তরে ইমাম হাসান বললেন : ক্বাবীরাহ গুনাহকারী ফাসিক মুমিন । উপস্থিত শিষ্যগণের মধ্য থেকে ওয়াসিল বিন আতার নিকট ইমাম সাহেবের এই উত্তরটি যথার্থ মনে হলো না । তিনি দাঁড়িয়ে বল্লেন : ক্বাবীরাহ গুণাহকারী মুমিনও নয় আবার কাফিরও নয় , বরং উভয় অবস্থার মধ্যস্থলে অবস্থিতএকথা বলে তিনি মসজিদের এক কোণে গিয়ে নিজের এই মতবাদ বারবার ব্যাখ্যা করতে লাগলেন । ইমাম সাহেব ওয়াছিল বিন আতার উপর বিরক্ত হয়ে বললেন- هو اعتزل عنا 
(
হুয়া ইতাযালা আন্না ) অর্থাৎ- সে আমাদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে । ইমাম সাহেবের পবিত্র জবান নিসৃত এই তাযালা শব্দটি হতেই ওয়াছিল বিন আতা এবং তার সমর্থকগণ মুতাযিলা নামে পরিচিত হয় । তবে মুতাযিলাগণ নিজেদেরকে ন্যায়পন্থি ও তাওহীদবাদী বলে দাবী করে থাকে ।
মুতাযিলাদের ক্রমবিকাশ :

ওয়াছিল বিন আতা স্বীয় মতবাদ প্রচার করতে থাকলে তার সমর্থকদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে । আমর বিন ওবায়েদ, আবুল হুযাইল আল আল্লাফ , ইব্রাহীম সাইয়্যার আননাজ্জাম প্রমূখ পন্ডিতবর্গ এই দলে যোগদান করেন । এই বিদগ্ধ মনীষীগণ মুতাযিলা মতবাদকে যুক্তি-প্রমানের সহিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বহু সংখ্যক গ্রন্থ প্রনয়ন করেন । তদুপরি আব্বাসীয় খলিফাদের সক্রিয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এই মতবাদটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । খলিফা আলমানসুরের পৃষ্ঠপোষকতায় মুতাযিলা সম্প্রদায় অপ্রতাশিত অগ্রগতি লাভ করে । খলিফা আলমামুনের শাসনকাল ছিল মুতাযিলাদের জন্য উৎকৃষ্ট সময় । তিনি খলিফা হারুন অর রশিদ কতৃর্ক মুক্ত আলোচনার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং সকল যুক্তিনিষ্ঠ বিদ্যান ব্যক্তিবর্গকে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব আলোচনায় অংশ গ্রহণ করার জন্য আহবান জানান । খলিফার আহবানে সাড়া দিয়ে মুতাযিলা পন্ডিতবর্গ খলিফার রাজদরবারে তত্ত্বালোচনার অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করেন । এতে খলিফা মুতাযিলাদের যুক্তি তর্কে চরমভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েন । খলিফা মুতাযিলাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা করেন । তিনি ক্বাজীর পদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুতাযিলা মতালন্বীদের নিয়োগ করেন । এদের প্রচেষ্টায় মুতাযিলা মতবাদের প্রসার ঘটে । সে যুগে মুতাযিলা পন্ডিতগণ ভিন্ন মতালন্বিদের তর্কযুদ্ধে হারিয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন । খলিফা মামুন মুতাযিলা মতবাদে এমনভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে, এই মতবাদ গ্রহণ করার জন্য তিনি বলপ্রয়োগ করতেও দ্বিধাবোধ করেননি । মুতাযিলা মতবাদ গ্রহণ না করায় তিনি আহমাদ বিন হান্বলকে কারারুদ্ধ করেন ও তাঁর হাত ভেঙ্গে দেন । খলিফা মামুনের পর খলিফা আল মুতাসিম ও খলিফা আল ওয়াসিক মুতাযিলাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন । কিন্তু আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিল মুতাযিলাদের সকল প্রকার রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতা রহিত করেন । অপর খলিফা ক্বাদির বিল্লাহ মুতাযিলাদের প্রতি কঠোরনীতি অবলন্বন করেন এবং তাদের নির্যাতন করতেও দ্বিধাবোধ করেননি ।
পরিশেষে তাতারী বংশদ্ভূত মোঙ্গলীয় কর্তৃক বাগদাদ আক্রমন যুক্তিবাদী মুতাযিলাদের ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয় । মোঙ্গলীয়গণ নির্বিচারে মুক্ত চিন্তাবীদদের হত্যা করে এবং মুতাযিলাদের অনেক গবেষণাগার পুড়িয়ে দেয়পরে বাগদাদে দীর্ঘদিনের জন্য মুক্তচিন্তার পরিবেশ বিনষ্ট হয় । এভাবেই মুসলিম ইতিহাসে আবির্ভূত বুদ্ধিবাদী মুতাযিলা সম্প্রদায়ের পতন ঘটে ।
মুতাযিলা সমপ্রদায়ের মূলনীতি :

মুতাযিলা মতবাদ সাধারনত: পাচঁটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত । এই মূলনীতিগুলো হচ্ছে যথাক্রমে : 
০১. তাওহীদবা একত্ববাদ । ০২. আদলবা ন্যায়পরায়নতা । ০৩. ওয়াদ ও ওয়ায়ীদঅর্থাৎ পুরষ্কারর ওয়াদা ও শাস্তির ভীতি । ০৪. আলমুনযিলাতু বাইনাল মুনযিলাতাইন অর্থাৎ দুই অবস্থার মধ্যবর্তি অবস্থা । তার মানে-বিশ্বাস ও আমল এ দুয়ের সমন্বয়ে ঈমান । ০৫. আল আমরু বিল মারুফ ওয়ান নাহয়ূ আনিল মুনকার অর্থাৎ- ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ ।
মুতাযিলা সম্প্রদায়ের কতিপয় ভ্রান্তধারণা :

০১. আলকুরআন আল্লাহর সৃষ্টি :
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মতে আলকুরআন আল্লাহর কালাম । মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে গুণে গুণান্বিত, আল্লাহর কালামও সেই গুণে গুণান্বিত । আল্লাহ তায়ালা যেমন অনাদি, অনন্ত, চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীব; আল্লাহর কালামও তেমনি চিরন্তন ও অবিনশ্বর । এর লয় নেই , ক্ষয় নেই । কিন্তু মুতাযিলাগণ বলেন ক্বুরআন আল্রাহর সৃষ্টি । আল্লাহ পাকের অন্যান্য সৃষ্টি যেমন নশ্বর ও ধ্বংশীল, তেমনি আলক্বুআনও নশ্বর বা ধ্বংশশীল ।
০২. কর্মের স্রষ্টা :
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মতে মানুষের কর্ম ভাল হোক আর মন্দ হোক সমস্ত কর্মের স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা । মানুষকে আল্লাহ তায়ালা বিবেক-বুদ্ধিমত্তা ও ইখতিয়ারী ক্ষমতা দিয়েছেন । সে কারণে মানুষ ভাল-মন্দ কর্ম করলে পুরষ্কৃত বা তিরষ্কৃত হবে । এ জন্য বান্দাহ নিজেই দায়ী, আল্লাহ নন । কিন্তু মুতাযিলাদের মতে ভাল কাজের স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা আর মন্দ কাজের স্রষ্টা বান্দাহ নিজেই ।
০৩. ক্ববরের আযাব :
ক্ববরের আযাব প্রসঙ্গে অগণিত সহীহ হাদীস থাকা সত্ত্বেও মুতাযিলাগণ ক্ববরের আযাবকে অস্বীকার করেছে ।
০৪. ক্ববরের সওয়াল- জওয়াব :
সহীহ হাদীস ও ইজমা দ্বারা একথা প্রমানিত যে, ক্ববরে মনকার ও নাকীরে প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হবে । কিন্তু মুতাযিলা সম্প্রদায় তা অস্বীকার করেছে ।
০৫. পাপ পূণ্যেন ওজন :
আল্লাহ তায়ালা মানুষের পাপ-পূণ্য পরিমাপ করার জন্য কিয়ামতের দিবসে মিযান কায়েম করবেন । এ বিষয়ে অগণিত ক্বুরআনের আয়াত ও হাদীস রয়েছে । কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, মুতাযিলাগণ পাপ-পূণ্যের ওজন হওয়াকে সরাসরি অস্বীকার করেছে ।
০৬. পুলসিরাত :
সহীহ হাদীসে ইরশাদ হয়েছে : পুলসিরাত জাহান্নামের পৃষ্ঠোপরি স্থাপিত হবে । রাসূলগণের মধ্য থেকে আমিই সর্বপ্রথম আমার উম্মাতসহ তা অতিক্রম করবো । কিন্তু মুতাযিলাগণ পুলসিরাতের কথা অস্বীকার করেছে ।
০৭. আল্লাহর দীদার :
মুমিন বান্দাহগণ আখিরাতে আল্লাহ পাকের দীদার বা দর্শন লাভ করে ধন্য হবেন । ক্বুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা ইহা প্রমানিত । হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- তোমরা ক্বিয়ামতের দিনে তোমাদের রবকে এমন সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবে , যেমন আজকের দিনে তোমরা পূর্ণিমার চাঁদকে দেখতে পাও । কিন্তু মুতাযিলাগণ চাক্ষুষ দর্শনকে অস্বীকার করেছে । তারা বলে- আল্লাহর দর্শন হবে অন্তর চক্ষু দ্বারা । চর্ম চক্ষু দ্বারা সম্ভব নয় । 
এছাড়াও আরও অগণিত আক্বিদাহগত বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের সাথে মুতাযিলাদের মতবিরোধ রয়েছে । সংক্ষিপ্ত কলেবরে এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয় । এ পর্যায়ে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হলে আক্বাঈদ শাস্ত্র অধ্যয়ন করা প্রয়োজন ।

০৪. জাবরিয়া সম্প্রদায়
নামকরণ ও পরিচিতি :
জাবরিয়া শব্দটি আরবী জবর শব্দ হতে গৃহীত । জবর অর্থ- পূর্ব নির্ধারণ এবং বাধ্যকরণ । এই মতবাদের প্রবক্তা হলেন জাহম বিন সাফওয়ান
উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :
উমাইয়া শাসনামলে জাহম বিন সাফওয়ান তিরমিজ ও খোরাসানে সর্বপ্রথম এই মতবাদ প্রচার করেন । তিনি ছিলেন খুরাসানের গভর্ণর আল হারিস বিন সুরয়িজের সচিব । ৭৫৪খৃ: তিনি সালাম বিন আহওয়াজ আলমাজিনি কর্তক নিহত হন । 
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, উমাইয়া খলিফাদের মাত্র কয়েকজন শাসক ছাড়া প্রায় সকলেই জাবরিয়া মতবাদ বা অদৃষ্টবাদের সমর্থক ছিলেন । তারা ছিলেন এ সম্প্রদায়ের প্রধান পৃষ্ঠপোষক । উমাইয়া শাসকদের অধিকাংশই ছিলেন দুষ্কৃতি পরায়ন । নিজেদের কুকর্মের যৌক্তিকতা দেখাবার জন্যই এরা জাবরিয়াদের সমর্থন করেন । এই মতাদর্শের ছদ্মাবরণে থেকেই তারা নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত হতেন আর বলতেন যে, যাবতীয় কাজ-কর্ম আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হয়ে থাকে ।সুতরাং এ জন্য বান্দাহ দায়ী নয় । কেউ তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে তারা রাষ্টীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতেন ।
জাবরিয়া মতবাদ :
জাবরিয়া মতবাদের মর্ম কথা হলো-কর্ম ও ইচ্ছায় বান্দার কোন স্বাধীনতা নেই । বান্দার ভাল ও মন্দ যাবতীয় কাজ আল্লাহর সৃষ্টি । আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী বাধ্য হয়ে সে সব কিছু করে । এতে তার কোন ইখতিয়ার নেই । আল্লাহ তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী তাকে কর্মে নিয়োগ করেন । পাপ-পূন্য, ন্যায় বিচার, ভাল-মন্দ যাবতীয় কাজই মানুষ বাধ্য হয়ে করে থাকে । সুতরাং সে ভাল কাজের জন্য পুরষ্কার এবং এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তি পাবে না । অতএব দেখা যাচ্ছে যে, জাবরিয়া মতবাদ অদৃষ্টবাদরই নামান্তর । এই দলের মতে মানুষের কর্মের স্বাধীনতা এবং কর্ম ক্ষমতাও নেই । মানুষ জড় পদার্থ দিয়ে তৈরী পুতুলসম । যেমনে নাচায় তেমনে নাচে । বাংলাদেশের প্রয়াত প্রখ্যাত গায়ক ও শিল্পী আব্দুল আলিম রচিত জাবরিয়া আক্বিদাহ সন্বলিত একটি গান আমরা শুনতে পাই । 
ছায়াবাজি পুতুলরূপে গড়াইয়া মানুষ 
যেমনে নাচায় তেমনে নাচে পুতুলের কি দোষ ? ”
এ পর্যায়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বিদাহ হলো- মানুষ খোদ মুখতার তথা স্বাধীন সত্ত্বা । মানুষকে আল্লাহ তায়ালা ইখতিয়ারী ক্ষমতা অর্থাৎ কর্মের স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন । আল্লাহ তায়ালা তার মধ্যে জন্মগতভাবেই বিবেক, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন । যদ্দ্বারা সে ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করত: ভালটাকে ভাল হিসেবে গ্রহণ এবং মন্দকে মন্দ হিসেবে বর্জন করার ইখতিয়ারী ক্ষমতা লাভ করেছেন । আর তার মাঝে এই কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন বলেই তো তার চলার পথে ইসলামী জীবন বিধান দেওয়া হয়েছে এবং তার ভাল-মন্দ কর্মের আল্লাহ কাছে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দন্ডায়মান হতে হবে । ভাল কর্মের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কর্মের জন্য শাস্তি প্রদান করা হবে । মানুষকে জড়পদার্থের মতো পুতুল ও অসহায় করে সৃষ্টি করা হয়নি । অন্যথায় তার মন্দ কর্মের জন্য শাস্তি প্রদান করলে আল্রাহ তায়ালা জালিম গুণে বিভূষিত হবেন । অথচ আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার প্রতি সামান্যতম অবিচার করেন না ।
০৫ ক্বাদরিয়া সমপ্রদায় ” :
আরবী ক্বদর শব্দ হতে ক্বাদরিয়া নামটির উৎপত্তি । ক্বদর অর্থ শক্তি, নির্দ্ধারণ, ভাগ্য ইত্যাদি ।
ক্বাদরিয়া মতবাদ :
ক্বাদরিয়া মতবাদের সার কথা হচ্ছে তারা মানুষের ভাল-মন্দ তাক্বদীরকে অস্বীকার করে । তাদের মতবাদের সার কথা হলো মানুষ তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রনে সম্পূর্ণ ক্ষমতাবান । কর্ম ও ইচ্ছায় সে সম্পূর্ণ স্বাধীন । ভাল-মন্দ যাবতীয় কাজ করা ও না করার মধ্যে তার পূর্ণ ইখতিয়ার রয়েছে । ইচ্ছা করলে সে ন্যায় পথে চলতে পারে আবার ইছ্ছা করলে অন্যায় পথেও চলতে পারে । এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা তাকে বাধা প্রদান করেন না । অতএব তার কৃতকর্মের জন্য সে দায়ী হবে । পূন্যকর্মের জন্য সে পুরষ্কার এবং পাপ কর্মের জন্য শাস্তি পাবে । সুতরাং মানুষের ভাল-মন্দের তাক্বদীর বা ভাগ্যলিপি বলতে কিছু নেই । মানুষের জন্য তার কর্মই হলোই আসল ।এ পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে যে, ক্বাদরিয়া মতবাদটি জাবরিয়া মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ।
উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :
এই মতবাদেল প্রবর্তক হলেন মাবাদ আল জুহাইনী । পরবর্তীকালে তার বিশিষ্ট শিষ্য 
গায়লান দামেস্কী এই মতবাদের উৎকর্ষ সাধন করেন । 
প্র্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, উমাইয়া খলিফাদের মাত্র কয়েবজন শাসক ছাড়া প্রায় সকলেই জাবরিয়া মতবাদ বা অদৃষ্টবাদের সমর্থক ছিলেন । তারা স্বাধীন মতবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন । সুতরাং তারা ক্বাদরিয়া মতবাদকে বরদাস্ত করতে পারতেন না । এই মতবাদের প্রবক্তাগণ তাঁদের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হন । খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের নির্দেশে মাবাদ আলজুহায়নিকে এবং হিশাম বিন আব্দুল মালিকের নির্দেশে গায়লান দামেস্কীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় । কিন্তু কোন মতবাদ একবার গড়ে উঠলে তা দমন করা যায় না । উমাইয়া শাসকদের অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন সত্ত্বেও ক্বাদরিযা মতবাদের প্রদীপ শিখা নির্বাপিত হয়নি । বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে পরবর্তীকালে অধিকতর মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে । তবে উমাইয়া আমলের শেষের দিকে কয়েকজন শাসক স্বাধীন ও মুক্তবুদ্ধির প্রচারক ক্বাদিরিয়াগনকে সমর্থন ও সহোযোগিতা করেন । পরবর্তী পর্যায়ে এই ক্বাদরিয়া মতবাদই মুতাযিলা মতবাদ নামে পরিচিত হয় ।

ক্বাদরিয়া সম্প্রদায় পথভ্রষ্ট হওয়ার কারণ :
ঈমানের সর্বমোট সত্তর এরও অধিক শাখা রয়েছে । তন্মধ্যে Basic বা মৌলিক শাখা সাতটি । যাকে ।ঈমানের বুনিয়াদী শাখা বলে । অন্য ভাষায়- এটিকে ঈমানে মুফাসসাল বলা হয়ে থাকে । আলোচ্চ সাতটি বুনিয়াদী শাখার কোন একটিকে কেউ অস্বীকার করলে সে মুমিন থাকে না , কাফির হয়ে যায় । ঈমানে মুফাসসালের সাতটি শাখা নিম্নরূপ : 
آمنت بالله وملائكته وككتبه ورسوله واليوم الاخر والقدر خيره وشره من الله تعالى والبعث بعد الموت 
ঈমানের আলোচ্চ মৌলিক শাখাসমূহের মধ্য থেকে ষষ্ঠতম শাখা হচ্ছে- তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা । ক্বাদরিয়া সম্প্রদায় ঈমানের আলোচ্চ বেসিক শাখার মধ্য থেকে ত্বাকদীরকে অস্বীকার করে । যার কারণে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে ।
এ ছাড়াও ক্বাদরিয়া ও মারজিয়াদের প্রসঙ্গে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে :
عن ابن عباس ( رض ) قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : صنفان من امتي ليس لهما فى الاسلام نصيب،المرجية
والقدرية - ( رواه الترمذى = رقم الحديث – 2075 ) 
অনুবাদ : ইবনু আব্বাস ( রা: ) হতে বর্ণিত : রাসূল ( সা: ) বলেছেন : আমার উম্মাতের দুই শ্রেণীর মানুষ , যাদের ইসলামে কোন অংশ নেই । তারা হলো যথাক্রমে – ( ০১ ) মুরজিয়া ( তাক্বদীরের উপর ভরসা করে আমল বর্জনকারী দল ) ( ০২. ) ক্বাদরিয়া ( তাক্বদীরকে অস্বীকারকারী দল । ( তথ্য সূত্র = তিরমিজি : হাদীস নং- ২০৭৫ )
অপর হাদীসে ক্বাদরিয়াদের সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে :
عن ابن عمر ( رض ) قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : القدرية مجوس هذه الامة ، ان مرضوا فلا تعود وا و ان ماتوا فلا تشهدوهم – ( رواه احمد = 5327 - وابو داؤد= 4071 ) 
অনুবাদ : ইবনু উমার হতে বর্ণিত : তিনি বলেন : আমার উম্মাতের ক্বাদরিয়া অর্থাৎ- তাক্বদীর অস্বীকারকারী দল অগ্নিপূজক । তারা অসুস্থ হলে তোমরা দেখতে যেয়ো না । মৃত্যু বরণ করলে জানাযার ছালাতে অংশ গ্রহণ করো না । 
(
তথ্যসূত্র : মুসনাদে আহমাদ= হাদীস নং-৫৩২৭ ; সুনানু আবু দাউদ = হাদীস নং- ৪০৭১ )
আলোচ্য দুটো হাদীস দ্বারা এ কথা প্রতীয়মান হলো যে, ক্বাদরিয়া ও মুরজিয়া সম্প্রদায় ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট দল । এ পর্যায়ে আমাদের জন্য হেদায়েতী আক্বিদাহ হলো- তাক্বদীরকে অস্বীকার করা যেমন কুফুরী , তেমনিভাবে নেক আমল বর্জন করত: তাক্বদীরের উপর ভরসা করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতেও শরীয়াতে নিষিদ্ধ হয়েছে । তাক্বদীরের বিশ্বাস স্থাপনের পাশাপাশি নেক আমলের প্রচেষ্টা ও তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে ।
এ পর্যায়ে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে :
عن على ( رض ) قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : اعملوا فكل ميسر لما خلق له 
(
رواه البخارى = رقم الحديث- 4949 – ومسلم = رقم الحديث- 2648 - ) 
:
অনুবাদ আলী ( রা: ) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন : রাসূল ( সা: ) বলেছেন : তোমরা আমল করতে থাকো ; কেননা যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে , তার জন্য সেই কাজকে সহজ করে দেওয়া হয়েছে । 
(
তথ্যসূত্র = বুখারী-হাদীস নং-(৪৯৪৯) ; মুসলিম- হাদীস নং- ২৬৪৮ )
০৬.মুরজিয়া সম্প্রদায় :

নামকরণ ও পরিচিতি :
মুরজিয়া শব্দটি আরবী এরজাউন শব্দ হতে উৎপন্ন । ইরজা অর্থ- স্থগিত রাখা বা আশাবাদী হওয়া । মুরজিয়াগণ আমলকে গৌণ মনে করত: ঈমানের পশ্চাতে স্থান দিয়ে থকেন । ছগীরাহ ও কাবীরাহ সব রকমের গুনাহ করার পরও জান্নাত বাসীর হওয়ার আশা পোষণ করেন । তারা তাক্বদীরের উপর ভরসা করে নেক আমল বর্জন করে থাকেন । তারা মনে করেন- তাক্বদীরে জান্নাত থাকলে জান্নাত হবে, জাহান্নাম থাকলে জাহান্নাম হবে ; সুতরাং নেক আমল করে লাভ নেই ।
উৎপত্তি ও ইতিহাস :
ঐতিহাসিকগণ মুরজিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব নিয়ে বিভিন্ন কারণ বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ এই সম্প্রদায়কে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বর্ণনা করলেও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করলে একথা বলা চলে যে, ধর্মীয় কারণেই মুরজিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে । 
এই মুরজিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব সম্পর্কে আব্রাহাম হালকিন বলেন
খারিজী ও শিয়া সম্প্রদায় যখন উমাইয়া শাসকদের কাফির বলে চিত্রিত করে, তখন মুরজিয়া সম্প্রদায় উমাইয়াদের স্বপক্ষে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে । তারা বলে : উমাইয়া শাসকদের হেয় প্রতিপন্ন করা মুসলমানদের উচিৎ নয়, আল্লাহর বিচারের পূর্ব পর্যন্ত তাদের সম্পর্কে ধর্মীয় ও নৈতিক রায় প্রদান স্থগিত রাখা উচিত ।
মুরজিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব সম্পর্কে ঐতিহাসিক ম্যাকডোনাল্ড বলেন :
মুসলমানগণ যখন নিজেদের পাপকর্ম সম্পর্কে অতি সচেতনতায় ভুগছিল , যখন তাদের সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে নৈরাশ্যবাদ ও অদৃষ্টবাদের কালো মেঘ নেমে এসেছিল, তখনই সহনশীল ও উদারপন্থি মুরজিয়াদের আবির্ভাব ঘটে । মুরজিয়ারা মুসলমানদের অহেতুক ভীতি ও নৈরাশ্যবাদের বিরোধিতা করেন । তারা বলেন- যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে , তারা যে পাপই করুক না কেন , তারা ধর্মচূ্যত হবে না এবং তাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত প্রদান করাও কারোর উচিৎ হবে না ।
মুরজিয়া মতবাদ :
মুরজিয়াদের মতে শুধু অন্তরে বিশ্বাস করার নাম ঈমান । মুখে স্বীকার করা এবং আমল করা ঈমানের জন্য জরুরী নয় । তাদের মতে- আমল ঈমানের রুকন বা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয় । অতএব মুমিন হওয়ার জন্য আমল শর্ত নয়, অন্তরে বিশ্বাস রেখে মুখে স্বীকার করাই যথেষ্ট । সুতরাং কেউ যদি অন্তরে বিশ্বাস রেখে নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত ইত্যাদি ফরজ আমলগুলো পরিত্যাগ করে এবং ক্বাবীরাহ গুনাহও যদি করে বসে , তবুও সে মুমিন থাকবে , কাফির হবে না । তাদের মতে একমাত্র কাফির ছাড়া আর কেউ চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না । ফরজ কাজ বর্জনকারী ও ক্বাবীরাহ গুনাহকারী যেহেতু কাফির নয়, সেইহেতু তারা চিরকাল জাহান্নামে অবস্থান করবে না এবং তারা আল্লাহ পাকের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক জান্নাতে প্রবেশ করবে । অতএব দেখা যাচ্ছে যে, খারিজীদের সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শ নিয়ে মুরজিয়াগণ আবির্ভূত হয়েছেন ।

০৭. আশায়েরা সম্প্রদায় :
নামকরণ ও পরিচিতি :
নবী কারীম ( সা: ) এর বিশিস্ট সাহাবী আবু মুসা আশআরী ( রা; ) এর বংশধর ইমাম আবুল হাসান আল আশআরী ( রহ: ) এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা । তারই নামানুসারে এই আশায়েরা মতবাদ পরিচিত । ইমাম আশআরী তদানিন্তন জাবরিয়াদের উত্তরসূরী সিফাতিয়াদের মতবাদ এবং ক্বাদরিয়াদের উত্তরসূরী মুতাযিলাদের মাঝামাঝি একটি মধ্যমপন্থি একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেন ।

আশোয়েরা মতবাদ প্রতিষ্ঠার কারণ :

মুতাযিলাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছিল জটিল । সর্বসাধারণের নিকট উহা বোধগম্য ছিল না । তদোপরি এই জটিল মতবাদ দ্বারা জনগণের বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল । একারণে তদানিন্তন রক্ষনশীল ওলামায়ে কিরাম এই মতবাদটিকে ভাল চোখে দেখতেন না । মুতাযিলাদের সমর্থক আব্বাসীয় খলিফা আলমামুন এই রক্ষনশীল ওলামাদের উপর নির্যাতনের ষ্টিম রোলার চালাতে শুরু করেন । কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয় । খলিফার এই আচরণে সাধারণ মুসলমান ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন । এই সংকটময় মূহুর্তে ইখওয়ানুস সাফা নামক একদল বিদগ্ধ পন্ডিত জনগণের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আকাঈদ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপর বহুসংখ্যক সারগর্ভ মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করত: লিফলেট আকারে তা প্রচার করতে থাকেন । মুসলিম সমাজে এহেন ক্রান্তি লগ্নে আশআরী তার মধ্যমপন্থী মতবাদ নিয়ে জনগণের সম্মুখে উপস্থিত হন । ইমাম আশআরী প্রথম জীবনে মুতাযিলা মতবাদের অনুসারী ছিলেন । পরবর্তীতে তার মতের পরিবর্তন হলে তিনি মুতাযিলা মতবাদ পরিহার করে নতুন এই মতবাদ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন । 
ইমাম আশআরীর মতের পরিবর্তন হলে তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে, শুধু বুদ্ধির দ্বারা সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং জীবনের সকল প্রশ্নের সমাধান করা সম্ভব নয় । অতএব তিনি স্বাধীন ও মুক্তবুদ্ধির ধারক ও বাহক চরমপন্থি মুতাযিলা মতবাদ পরিহার করেন এবং ওহী বা কালামে এলাহীকে সত্য নিরূপনের নির্ভূল মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করত: গবেষণা শুরু করেন । তারপর তিনি ছিফাতিয়া ও মুতাযিলাদের চরমপন্থি দুটি মতবাদের মধ্যবর্তি একটি মতবাদ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন । 
উল্লেখ্য যে, আশায়েরা মতবাদের সহিত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মতবাদের প্রায় মিল 
আছে ।
উপসংহার : 
অত্র বক্ষমান প্রবন্ধে আলোচিত বিভিন্ন বাতিল ফিরকাহ ছাড়াও মুসলিম বিশ্বে আরও বহু সংখ্যক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে । প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় এখানেই আমার আলোচনার যবনিকা টানতে বাধ্য হলাম । উল্লেখিত সম্প্রদায়গুলোর মধ্য থেকে একমাত্র 
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত নামক দলটিই হলো ফিরক্বায়ে নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল । আল্লাহ তায়লা আমাকে আপনাকে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভূক্ত করত: দুনিয়া ও আখিরাতে কাময়াবী 
হাছিল করার নেক তাওফিক দান করুন । - আমীন ।
-নিবেদক 
উপস্থাপনায়
মো: ইসহাক মিয়া 
সহকারী অধ্যাপক ( কামিল হাদীস বিভাগ ) 
বিজুল দারুল হুদা কামিল স্নাতকোত্তর মাদরাসা 
বিরামপুর, দিনাজপুর ।

No comments:

Post a Comment