Sunday 16 April 2017

কবর যিয়ারত

৯. কবর যিয়ারতের সময় সূরা ইখলাস পাঠ
প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে রয়েছে: “কবরস্থানে যেয়ে সূরা ইখলাস ১১ বার পাঠ করে মৃত ব্যক্তিগণের রূহের উপর বখশিয়া দিলে সে ব্যক্তি কবরস্থানের সমস্ত কবরবাসীর সম সংখ্যক নেকী লাভ করবে”। মূলত কথাটি একটি জাল হাদীসের প্রচলিত অনুবাদ। জাল হাদীসটিতে বলা হয়েছে:
مَنْ مَرَّ بِالْمَقَابِرِ فَقَرَأَ (قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ) إِحْدَى وَعِشْرِيْنَ مَرَّةً ثُمَّ وَهَبَ أَجْرَهُ لِلأَمْوَاتِ أُعْطِيَ مِنَ الأَجْرِ بِعَدَدَ الأَمْوَاتِ
“যদি কেউ গোরস্থানের নিকট দিয়ে গমন করার সময় ২১ বার ‘সূরা ইখলাস’ পাঠ করে তার সাওয়াব মৃতগণকে দান করে তবে মৃতগণের সংখ্যার সমপরিমাণ সাওয়াব তাকে প্রদান করা হবে।”
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল। 
১০. মৃত্যুর সময় শয়তান পিতামাতার রূপ ধরে আসে
সাধারণের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে শয়তান তার পিতামাতার রূপ ধরে আগমন করে এবং তাকে বিভিন্ন ওয়াসওয়াসার মাধ্যমে বিপথগামী করার চেষ্টা করে। ইমাম সুয়ূতী, ইবনু হাজার মাক্কী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এ বিষয়ে কোনো কথা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। 
১১. গায়েবানা জানাযা আদায় করা
যে মৃতব্যক্তির মৃত্যুর স্থানে একবার জানাযার সালাত আদায় করা হয়েছে তার জন্য পুনরায় ‘গায়েবী জানাযা’ আদায় করার পক্ষে কোনোরূপ হাদীস বর্ণিত হয় নি; বরং এ কর্মটি সুন্নাত বিরোধী একটি কর্ম। “এহইয়াউস সুনান” গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। 
নিজামউদ্দীন আউলিয়ার নামে প্রচলিত ‘রাহাতিল কুলুব’ নামক বইয়ে আছে যে, ফরীদউদ্দীন গঞ্জেশক্কর বলেন: “গায়েবানা জানাজার নামাজ পড়ার বিধান রয়েছে। কেননা আমীরুল মুমেনীন হযরত হামযাহ ও অন্যান্যরা যখন শহীদ হলেন তখন হুজুর পাক (স.) তাঁদের জন্য গায়েবানা জানাজার নামাজ পাঠ করেছিলেন। এমনকি প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক ভাবে পড়েছিলেন।” 
এসকল কথা কি সত্যিই খাজা নিজামউদ্দীন (রাহ) লিখেছেন, না তাঁর নামে জালিয়াতি করা হয়েছে তা আমরা জানি না। তবে সর্বাবস্থায় এগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন কথা। একজন সাধারণ মুসলিমও জানেন যে, হামযা (রা) উহদের যুদ্ধে শহীদ হন এবং রাসূলুল্লাহ (স.) স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
১২. মৃত লাশকে সামনে রেখে উপস্থিতগণকে প্রশ্ন করা
আমাদের দেশে অনেক সময় সালাতুল জানাযা আদায়ের পূর্বে  বা পরে মৃতদেহ সামনে রেখে উপস্থিত মুসল্লীগণকে প্রশ্ন করা হয়, লোকটি কেমন ছিল? সকলেই বলেন: ভাল ছিল... ইত্যাদি। এ কর্মটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। হাদীস শরীফে এরূপ কোনো কর্মের উল্লেখ নেই। হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনো মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে যদি মানুষেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশংসা করেন তবে তা সেই ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর বলে গণ্য হবে। 
১৩. মৃতকে কবরে রাখার সময় বা পরে আযান দেওয়া
প্রচলিত আরেকটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কর্ম হলো মৃতকে কবরে রাখার সময় বা পরে আযান দেওয়া। কোনো সহীহ যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসেও এরূপ কোনো কথা রাসূলুল্লাহ (স.)বা কোনো সাহাবী থেকে বর্ণিত হয় নি। এমনকি নামাযের ওয়াক্ত ছাড়া অন্য কোনো কারণে আযান দেয়ার কোনো প্রকারের ফযীলতও কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
১৪. ভূত-প্রেতের ধারণা
আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও ইসলাম বিরোধী ধারণা হলো ভুত-প্রেতের ধারণা। মৃত মানুষের আত্মা ভুত বা প্রেত হয়ে বা অন্য কোনোভাবে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, অবস্থান করে, ভাল বা মন্দ করতে পারে... ইত্যাদি সকল কথাই জঘন্য মিথ্যা ও ইসলামী বিশ্বাসের বিপরীত কথা। এ জাতীয় বাতিল কথা হলো, মৃতের আত্মা তার মৃত্যুর স্থানের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়... ইত্যাদি।
১৫. মৃত্যুর পরে লাশের নিকট কুরআন তিলাওয়াত করা
মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ মুহূর্তগুলোতে সূরা ইয়াসীন পাঠ করে শুনানোর বিষয়ে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।  কিন্তু মৃত্যুর পরে লাশের কাছে কুরআন তিলাওয়াত করার বিষয়ে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস বর্ণিত হয় নি।
১৬. লাশ বহনের সময় সশব্দে কালিমা, দোয়া বা কুরআন পাঠ
এটি একটি বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও সুন্নাতের বিপরীত কর্ম। লাশ বহনের সময় পরিপূর্ণ নীরবতাই সুন্নাত। মনের গভীরে শোক ও মৃত্যু চিন্তা নিয়ে নীরবে পথ চলতে হবে। পরস্পরে কথাবার্তা বলাও সুন্নাত বিরোধী। ইমাম নাবাবী বলেন, লাশ বহনের সময় সম্পূর্ণ নীরব থাকাই হলো সুন্নাত সম্মত সঠিক কর্ম যা সাহাবীগণ ও পরবর্তী যুগের মানুষদের রীতি ছিল। প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা কাসানী বলেন: 
وَيُطِيلُ الصَّمْتَ إذَا اتَّبَعَ الْجِنَازَةَ وَيُكْرَهُ رَفْعُ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ لِمَا رُوِيَ عَنْ قَيْسِ بْنِ عُبَادَةَ أَنَّهُ قَالَ : كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ  يَكْرَهُونَ الصَّوْتَ عِنْدَ ثَلاثَةٍ: عِنْدَ الْقِتَالِ، وَعِنْدَ الْجِنَازَةِ، وَالذِّكْرِ؛ وَلأَنَّهُ تَشَبُّهٌ بِأَهْلِ الْكِتَابِ فَكَانَ مَكْرُوهًا .
“লাশের অনুগমনকারী তার নীরবতাকে প্রলম্বিত করবে। এ সময় সশব্দে যিকর করা মাকরূহ। কাইস ইবনু উবাদাহ বলেন: রাসূলুল্লাহ (স.)-এর সাহাবীগণ তিন সময়ে শব্দ করতে অপছন্দ করতেন: যুদ্ধ, জানাযা এবং যিক্র। এছাড়া লাশ বহনের সময় সশব্দে যিক্র করা ইহূদী-নাসারাগণের অনুকরণ; এজন্য তা মাকরূহ।” 
১৭. কবরের কাছে দান-সাদকা করা
হাদীস শরীফে সন্তানকে তার মৃত পিতামাতার জন্য দান-সাদকা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ দান কবরের নিকট করলে কোনো অতিরিক্ত সাওয়াব বা সুবিধা আছে বলে কোনো হাদীসে কোনোভাবে বর্ণিত হয় নি। বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে দান করার একই অবস্থা। 
১৮. সন্তান ছাড়া অন্যদের দান সাদকা
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, সন্তান-সন্ততি বা পরিবারবর্গ ছাড়া অন্য কেউ দান করলে মৃত ব্যক্তি সাওয়াব পাবেন বলে কোনো হাদীসে কোনোভাবে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় বা করা হয় সবই আলিমদের মতামত ভিত্তিক, অথবা মনগড়া ও বানোয়াট। 
কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুমিনগণের দায়িত্ব হলো মৃত মুমিনগণের জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করা। আর সন্তানদের দায়িত্ব হলো মৃত পিতামাতার জন্য দোয়া ও ইসতিগফার ছাড়াও দান করা। সন্তান-সন্ততি ছাড়া অন্যান্য মানুষ দোয়া করলে মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন বলে আমরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিশ্চিত জানতে পারি। কিন্তু সন্তান ছাড়া কেউ দান করলে মৃত ব্যক্তি সাওয়াব পাবেন বলে কোনো সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি।
তবে অধিকাংশ আলিম মনে করেন যে, সন্তানের দানের সাওয়াব যেহেতু মৃত ব্যক্তি লাভ করবেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সেহেতু আমরা আশা করতে পারি যে, অন্যান্য মানুষের দানের সাওয়াবও মৃত ব্যক্তি পেতে পারেন। কোনো কোনো আলিম বলেন যে, এক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসের বাইরে আশা পোষণের কোনো ভিত্তি বা যুক্তি নেই। কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে কোনো মুসলিম যে কেনো মৃত মুসলিমের জন্য দোয়া করবেন। আর সন্তানসন্ততি পিতামাতার জন্য দোয়া ছাড়াও দান করবে। আমাদের এর বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। 
অধিকাংশ আলিমের ‘আশা’ মেনে নিলেও এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। যেহেতু কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারছি যে, দোয়া ও ইসতিগফার করলেই মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন এবং দোয়ার বিনিময়েই তাকে নেকি ও সাওয়াব দান করা হবে, সেহেতু কুরআন-হাদীসের নির্দেশের বাইরে দান করার প্রয়োজনীয়তা কী? যখন আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারছি যে, ‘হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তিকে আপনি ক্ষমা করুন, তাঁকে মর্যাদা দান করুন... ইত্যাদি’ বলে দোয়া করলেই সে ব্যক্তি উপকৃত হবেন, তখন আমাদের প্রয়োজন কী যে আমরা বলব: “হে আল্লাহ, আমার এ দানের সাওয়াব অমুককে প্রদান করুন এবং এর বিনিময়ে তাকে ক্ষমা করুন, মর্যাদা বা নেকি দান করুন”?
সম্ভবত আমরা মনে করি যে, দান-সাদকাসহ দোয়া করলে মৃতব্যক্তি বেশি সাওয়াব লাভ করবে। ‘গাইবী’ বিষয়ে নিজেরা ‘মনে’ করার চেয়ে ‘ওহী’-র উপর নির্ভর করা উত্তম। কুরআন ও হাদীসে দোয়া ও ইসতিগফারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (স.) নিজে আজীবন অগণিত মুমিন-মুমিনার জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করেছেন, কিন্তু কখনোই শেখান নি যে, কবর যিয়ারত বা অন্য সময়ে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া-ইসতিগফারের পূর্বে, পরে বা অন্য সময়ে কিছু দান-সাদকা বা খানা বিতরণ করা ভাল। তিনি নিজেও কখনো তা করেন নি এবং কাউকে তা শিক্ষাও দেন নি। সাহাবীগণও মৃতদের জন্য দোয়া-ইসতিগফার করেছেন এবং কবর যিয়ারত করেছেন, কিন্তু কখনোই কবরের পাশে বা অন্য কোথাও মৃতদের ‘সাওয়াব রেসানী’-র জন্য দান-খয়রাত করেছেন বলে সহীহ সনদে বর্ণিত হয় নি। আমাদের উচিত সুন্নাতের শিক্ষার মধ্যে থাকা। সকল মুমিনই নিজের সাওয়াব অর্জন, বিপদ মুক্তি ও বরকতের জন্য সর্বদা বেশি বেশি দান-সাদকা করতে চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি সন্তান-সন্ততি তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য দোয়া, ইসতিগফার ও দান করবে। আর অন্য সকল মুসলমান সকল মৃত মুমিন-মুমিনার জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করবে। 
১৯. মৃতের জন্য জীবিতের হাদিয়া
প্রচলিত ওয়ায-আলোচনায় একটি হাদীসে বলা হয় যে, মৃতব্যক্তি হলো ডুবন্ত মানুষের মত, জীবিতদের পক্ষ থেকে কুরআন, কালিমা, দান-খাইরাত ইত্যাদির সাওয়াব ‘হাদিয়া’ পাঠালে সে উপকৃত হয়। প্রকৃতপক্ষে হাদীসটিতে শুধু দোয়া-ইসতিগফারের কথা বলা হয়েছে, বাকি কথাগুলি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। মূল হাদীসটিও অত্যন্ত দুর্বল। ইমাম বাইহাকী তৃতীয় শতকের এজন অজ্ঞাত পরিচয় রাবী মুহাম্মাদ ইবনু জাবির ইবনু আবী আইয়াশ আল-মাসীসীর সূত্রে হাদীসটি সংকলন করেছেন। এ ব্যক্তি বলেন, তাকে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, তাকে ইয়াকূব ইবনু কা’কা বলেছেন, মুজাহিদ থেকে, তিনি ইবনু আব্বাস থেকে, রাসূলুল্লাহ(স.) বলেছেন:
مَا الْمَيِّتُ فِيْ الْقَبْرِ إِلاَّ كَالْغَرِيْقِ الْمُتَغَوِّثِ يَنْتَظِرُ دَعْوَةً تَلْحَقُهُ مِنْ أَبٍ أَوْ أُمٍّ أَوْ أَخٍ أَوْ صَدِيْقٍ فَإِذَا لَحِقَتْهُ كَانَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا وَإِنَّ اللهَ لَيُدْخِلُ عَلَى أَهْلِ الْقُبُوْرِ مِنْ دُعَاءِ أَهْلِ الأَرْضِ أَمْثَالَ الْجِبَالِ وَإِنَّ هَدِيَّةَ الأَحْيَاءِ إِلَى الأَمْوَاتِ الاسْتِغْفَارُ لَهُمْ 
“ডুবন্ত ত্রাণপ্রার্থী ব্যক্তির যে অবস্থা, অবিকল সে অবস্থা হলো কবরের মধ্যে মৃতব্যক্তির। সে দোয়ার অপেক্ষায় থাকে, যে দোয়া কোনো পিতা, মাতা, ভাই বা বন্ধুর পক্ষ থেকে তার কাছে পৌঁছাবে। যখন এরূপ কোনো দোয়া তার কাছে পৌঁছে তখন তা তার কাছে দুনিয়া ও তন্মধ্যস্থ সকল সম্পদের চেয়ে প্রিয়তর বলে গণ্য হয়। এবং মহিমাময় পরাক্রমশালী আল্লাহ পৃথিবীবাসীদের দোয়ার কারণে কবরবাসীদেরকে পাহাড় পরিমাণ (সাওয়াব) দান করেন। আর মৃতদের প্রতি জীবিতদের হাদিয়া হলো তাদের জন্য ইসতিগফার বা ক্ষমা-প্রার্থনা করা।”
ইমাম বাইহাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, একমাত্র মুহাম্মাদ ইবনু জাবির ইবনু আবী আইয়াশ নামক এ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সূত্রে কোনোভাবে এই হাদীসটি বর্ণিত হয় নি।  ইমাম যাহাবী এ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেন: “এ ব্যক্তির কোনো পরিচয়ই আমি জানতে পারি নি। এ ব্যক্তি বর্ণিত হাদীসটি অত্যন্ত আপত্তিকর বা খুবই দুর্বল (منكر جدا)।” 
২০. মৃতের জন্য খানাপিনা, দান বা দোয়ার অনুষ্ঠান
মৃত ব্যক্তির জন্য মৃত্যুর পরে ৩য় দিন, ৭ম দিন, ৪০তম দিন, অন্য যে কোনো দিনে, মৃত্যু দিনে বা জন্ম দিনে খানাপিনা, দান-সাদকা, দোয়া-খাইর ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত রীতি। তবে রীতিটি একেবারেই বানোয়াট। এ সকল দিবসে মৃতের জন্য কোনো অনুষ্ঠান করার বিষয়ে কোনো প্রকার হাদীস বর্ণিত হয় নি। কোনো মানুষের মৃত্যুর পরে কখনো কোনো প্রকারের অনুষ্ঠান করার কোনো প্রকারের নির্দেশনা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। সদা সর্বদা বা সুযোগমত মৃতদের জন্য দোয়া করতে হবে। সন্তানগণ দান করবেন। এবং সবই অনানুষ্ঠানিক। এ বিষয়ে ‘এহইয়াউ সুনান’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। 
২১. অসুস্থ ও মৃত ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন প্রকারের খতম
খতমে তাহলীল, খতমে তাসমিয়া, খতমে জালালী, খতমে খাজেগান, খতমে ইউনূস ইত্যাদি সকল প্রকার ‘খতম’ পরবর্তী কালে বানানো। এ বিষয়ে হাদীস নামে প্রচলিত বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: “হাদীস শরীফে আছে, হযরত (স.) ফরমাইয়াছেন, যখন কেহ নিম্নোক্ত কলেমা (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার পড়িয়া কোন মৃত ব্যক্তির রূহের উপর বখশিশ করিয়া দিবে, তখন নিশ্চয়ই খোদাতাআলা উহার উছিলায় তাহাকে মার্জনা করিয়া দিবেন ও বেহেশ্তে স্থান দিবেন।”  এগুলো সবই বানোয়াট কথা।
২২. মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন খতম
আমাদের দেশের অতি প্রচলিত কর্ম কারো মৃত্যু হলে তার জন্য কুরআন খতম করা। এ কর্মটি কোনো হাদীস ভিত্তিক কর্ম নয়। কোনো মৃত মানুষের জন্য রাসূলুল্লাহ (স.) ও সাহাবীগণ কখনো কুরআন খতম করেন নি। এছাড়া কারো জন্য কুরআন খতম করলে তিনি সাওয়াব পাবেন এরূপ কোনো কথাও কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয় নি। 
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, কুরআন ও হাদীসে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সন্তানগণকে মৃত পিতামাতার জন্য দান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ, সিয়াম পালন, হজ্জ ও উমরা পালনের কথাও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন খতম, তাসবীহ তাহলীল পাঠ ইত্যাদি ইবাদতের কোনো নির্দেশনা হাদীসে বর্ণিত হয় নি। তবে অধিকাংশ আলিম বলেছেন যে, যেহেতু দান, সিয়াম, হজ্জ, উমরা ও দোয়ার দ্বারা মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সেহেতু আশা করা যায় যে, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ তাহলীল ইত্যাদি ইবাদত দ্বারাও তারা উপকৃত হবেন। তবে এজন্য আনুষ্ঠানিকতা, খতম ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
২৩. দশ প্রকার লোকের দেহ পচবে না
প্রচলিত একটি পুস্তকে রয়েছে: “হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, নিম্নলিখিত দশ প্রকার লোকের দেহ কবরে পচবে না: ১- পয়গম্বর, ২-শহীদ, ৩- আলেম, ৪- গাজী, ৫- কুরআনের হাফেয, ৬- মোয়ায্যিন, ৭- সুবিচারক বাদশাহ বা সরদার, ৮-সূতিকা রোগে মৃত রমণী, ৯-বিনা অপরাধে যে নিহত হয়, ১০-শুক্রবারে যার মৃত্যু হয়।” 
এদের অনেককেই হাদীসে শহীদ বলা হয়েছে। তবে একমাত্র নবীগণ বা পয়গম্বরগণের দেহ মাটিতে পচবে না বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। অন্য নয় প্রকারের মৃতগণের মৃতদেহ না পচার বিষয়ে কোনো হাদীস আছে বলে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করেও জানতে পারি নি। আল্লাহই ভাল জানেন।
(খ) কুরআন সংশ্লিষ্ট দুআ-তদবীর
আমাদের দেশে কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরা বা আয়াত বিষয়ক দু প্রকারের কথা প্রচলিত। এক প্রকারের কথা ফযীলত বা আখিরাতের মর্যাদা, সাওয়াব, আল্লাহর দয়া ইত্যাদি বিষয়ক। দ্বিতীয় প্রকারের কথা ‘তদবীর’ বা দুনিয়ায় বিভিন্ন ফলাফল লাভ বিষয়ক। 
উমার আল-মাউসিলীর আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন সূরা ও আয়াতের ফযীলতে কিছু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া প্রচলিত বাকি হাদীসগুলো অধিকাংশই যয়ীফ অথবা বানোয়াট। বিশেষত, তাফসীর কাশ্শাফ ও তাফসীর বায়যাবীর প্রতিটি সূরার শেষে সে সূরার ফযীলত বিষয়ক যে সকল কথা বলা হয়েছে তা মূলত এ বিষয়ক দীর্ঘ জাল হাদীসটি থেকে নেওয়া হয়েছে। আমাদের সমাজে প্রচলিত পাঞ্জ-সূরার ফযীলত বিষয়ক অধিকাংশ কথাই যয়ীফ অথবা জাল। এ বিষয়ক যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এগুলোর বিস্তারিত আলোচনার জন্য পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন। এ বইয়ের কলেবর ইতোমধ্যেই অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এজন্য আমরা এ বইয়ে ফযীলত বিষয়ক যয়ীফ ও জাল হাদীসগুলো আর আলোচনা করছি না। বরং এখানে আমল-তদবীর বিষয়ক কিছু কথা উল্লেখ করছি।
কুরআনের আয়াত দ্বারা ঝাড়ফুঁক দেওয়া বা এগুলোর পাঠ করে রোগব্যাধি বা বিপদাপদ থেকে মুক্তির জন্য ‘আমল’ করা বৈধ। হাদীস শরীফে ‘কুরআন’ দ্বারা ‘রুক্ইয়া’ বা ঝাড়ফুঁক করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া হাদীসের দোয়া বা যে কোনো ভাল অর্থের বাক্য দ্বারা ঝাড়ফুঁক দেয়া বৈধ। 
ঝাড়ফুঁক বা তদবীর দুই প্রকারের। কিছু ঝাড়ফুঁক বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ প্রকারের ঝাড়ফুঁক ও আমল সীমিত। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ঝাড়ফুঁক, আমল ইত্যাদি পরবর্তী যুগের বুযুর্গদের অভিজ্ঞতার আলোকে বানানো। যেমন, অমুক সূরা বা অমুক আয়াতটি এত বার বা এত দিন বা অমুক সময়ে পাঠ করলে অমুক ফল লাভ হয় বা অমুক রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এইরূপ সকল আমল বা তদবীরই বিভিন্ন বুযুর্গের অভিজ্ঞতা প্রসূত।
কেউ ব্যক্তিগত আমল বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ‘তদবীর’ বা ‘রুকইয়া শরঈয়্যা’ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। তবে এগুলির কোনো খাস ফযীলত আছে বা এগুলি হাদীস-সম্মত এরূপ ধারণা করলে রাসূলুল্লাহ (স.)এর নামে মিথ্যা বলা হবে। এছাড়া তদবীর বা আমল হিসেবেও আমাদের উচিত সহীহ হাদীসে উল্লিখিত তদবীর, দোয়া ও আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা। ঝাড়ফুঁক, ও দুআ-তাবীজ, যাদু-জিন ইত্যাদি বিষয়ক মাসনূন, জায়েয ও নিষিদ্ধ বিষয়াদি বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘রাহে বেলায়াত’ বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে।

No comments:

Post a Comment