Thursday 13 April 2017

সফরের ইসলামী আদব ও সুন্নাত


প্রথমত সফরের শুরুতে
কুরআন ও হাদীসের আলোকে হজ্জ বা উমরার সফরে বেরোনোর আগেই আমাদের করণীয়ঃ
- নিয়তের বিশুদ্ধতা অর্জন করা। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে সফর করতে হবে। কেউ আমাকে হাজী বলবে অথবা দ্বীনদার মনে করবে এমন নিয়তে হজ্জ করলে কোন সাওয়াব হবে না। রাসূল (সা:) বলেছেন:
مَنْسَمَّعَسَمَّعَاللَّهُبِهِ،وَمَنْيُرَائِييُرَائِياللَّهُبِهِ.
উচ্চারণ: মান সাম¥া‘আ সাম্মাআল্লাহু বিহি, ওয়ামান ইউরা-ঈ ইউরাঈল্লাহু বিহি।
অর্থ:“যে ব্যক্তি লোকশোনানো ইবাদত করে আল্লাহ তা‘আলা এর বিনিময়ে লোকদেরকে শুনিয়ে দিবেন। আর  যে ব্যক্তি লোকদেখানোর জন্য কোন আমল করবে আল্লাহ তা‘আলা এর বিনিময়ে লোকদেরকে দেখিয়েদিবেন।(আখেরাতে কোন বিনিময় পাবেনা।)( )
- সফর অবস্থায় নামায-রোজা ইত্যাদি ইবাদতের হুকুম-আহকাম ভালভাবে জানা।
- ওসিয়ত লিখে রাখা। একজন মুসলিমের উচিত সবসময় নিজের ওসিয়ত তৈরী রাখা। ইমাম বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বর্ণিত হাদীসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “ওসিয়ত করতে চায় এমন কোন মুসলিম ব্যক্তির এ অধিকার নেই যে, তাঁর লিখিত ওসিয়ত সঙ্গে না রেখে সে দুই রাত কাটাবে।”( ) বিশেষত সফরের প্রাক্কালে ওসিয়ত লিখে তা নিরাপদ স্থানে বা কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছে রেখে যাওয়া বিশেষভাবে মুস্তাহাব।
- সবার প্রাপ্য ও ঋণ পরিশোধ করা। কারো ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব না হলে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সফরে যেতে হবে।
- পরিবার-পরিজনেরভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা।রাসূলুল্লাহ (সা:)বলেছেন;
"كَفَىبالمرءِإثماًأنيضيّعَمَنْيَقُوتُ"
উচ্চারণ: কাফা বিলমার-ই ইছমান আঁইউদাইয়িআ মাইঁ ইয়াক্বুতু।
অর্থ:“একজন মানুষের জন্য বড় পাপ হলো নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত করা।”( )
- সফরের জন্য সৎ ও পরহেজগার সঙ্গী বেছে তাদের সাথে থাকা।
- নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে আমীর বা দলপতি নিয়োগকরা। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেছেন;
إِذَاكُنْتُمْفِيْسَفَرٍفَأَمِّرُوْاأَحَدَكُمْ
উচ্চারণ:ইযা কুনতুম ফী সাফারিন ফা-আম্মিরূ আহাদাকুম।
অর্থ:“তোমরা যদি সফরে যাও তাহলে তোমাদের মধ্য থেকেএকজনকে আমীর বানাবে।”( )
- আমীরের আনুগত্য করা কর্তব্য।হযরত রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন;
عَلَيْكَالسَّمْعَوَالطَّاعَةَفِيعُسْرِكَوَيُسْرِكَ،وَمَنْشَطِكَوَمَكْرَهِكَ،وَأَثَرَةٍعَلَيْكَ
উচ্চারণ:আলাইকাস সামআ’ ওয়াত্তআ’তা ফী ‘উসরিকা ওয়া ইয়ুসরিকা ওয়া মানশাতিকা ওয়া মাকরাহিকা ওয়া আসারাতিন ‘আলাইকা।
অর্থ: “দুঃখে-সুখে, খুশী-অখুশীতে এবং যদিও অন্য কাউকে তোমার উপরে প্রাধান্য দেয়া হয় তবুও সর্বাবস্থায় আমীরের নির্দেশ শোনা এবং আনুগত্য করা তোমার জন্য আবশ্যক।”(১)
- পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবদের নিকট থেকে বিদায় নেয়ার সময় নি¤েœর দু‘আটি পড়া;
"أَسْتَوْدِعُكَاللَّهَ [أَسْتَوْدِعُكُمُاللهَ] الَّذِيلَاتَضِيعُوَدَائِعُهُ

উচ্চারণ:আসতাদি‘উকা-ল্লাহাল্লাযি(বহুবচনে আসতাদি‘উ কুমুল্লাহাল্লাযি)লা তাদি‘উ ওয়াদায়ি‘উহু।
অর্থাৎ:“আমি তোমাকে [অথবা তোমাদেরকে]ওই আল্লাহর নিকট আমানত হিসেবে রেখে যাচ্ছি যার নিকট আমানত নষ্ট হয় না।”( )
- পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে সফরে বেরোনো।
- বৃহস্পতিবারে সফর শুরু করা, কারণ রাসূলুল্লাহ (সা:) এই দিনে সফর শুরু করতে পছন্দ করতেন।
- যানবাহনে উঠেতিনবার“আল্লাহু আকবার”বলা ওনি¤েœাক্ত দু‘আটি পড়া।
سُبْحَانَالَّذِيسَخَّرَلَنَاهَذَاوَمَاكُنَّالَهُمُقْرِنِينَ.وَإِنَّاإِلَىرَبِّنَالَمُنْقَلِبُونَ [الزخرف ১৩،১৪]اللهُمَّإِنَّانَسْأَلُكَفِيسَفَرِنَاهَذَاالْبِرَّوَالتَّقْوَى،وَمِنَالْعَمَلِمَاتَرْضَى،اللهُمَّهَوِّنْعَلَيْنَاسَفَرَنَاهَذَا،وَاطْوِعَنَّابُعْدَهُ،اللهُمَّأَنْتَالصَّاحِبُفِيالسَّفَرِ،وَالْخَلِيفَةُفِيالْأَهْلِ،اللهُمَّإِنِّيأَعُوذُبِكَمِنْوَعْثَاءِالسَّفَرِ،وَكَآبَةِالْمَنْظَرِ،وَسُوءِالْمُنْقَلَبِفِيالْمَالِوَالْأَهْلِ

উচ্চারণ:সুবহানাল্লাযী সাখ্খারা লানা হাযা, ওয়ামা কুন্না লাহু মুক্বরিনীন, ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুনক্বালিবুন।আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফি সাফারিনা হাযাল র্বিরা ওয়াত্তাক¦ওয়া, ওয়ামিনাল আমালে মা তারদা, আল্লাহুম্মা হাওয়িন আলাইনা সাফারানা হাযা, ওয়াতয়ি আন্না বু’দাহু, আল্লাহুম্মা আনতাছ ছাহিবু ফিস সাফারি,ওয়াল খলিফাতু ফিল আহলি, আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিন ওয়া’ছাইস সাফারি, ওয়া কাআবাতিল মানযারি, ওয়া সূ-ইল মুনক্বালাবি ফিল মালি ওয়াল আহলি।( )
- যথাসাধ্য আল্লাহর যিক্র ও তাওবা-ইস্তিগফার করা। এছাড়া হাদীসে বর্ণিত দু‘আ পড়তে থাকা। উঁচুস্থানে উঠতে “আল্লাহু আকবার” ও নিচুস্থানে নামতে “সুবহানাল্লাহ বলা।”
- দু‘আ-প্রার্থনায় মশগুল থাকা। হাদীসে এসেছেঃ তিন ব্যক্তির দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন; পিতা-মাতা, মুসাফির এবং অত্যাচারিত ব্যক্তি।”
- সফরসঙ্গীদের খেদমত করা ও তাদেরকে খুশী রাখা।
- কোন জনপদে প্রবেশের সময় হাদীসে বর্ণিত নীচের দু‘আ পাঠ করাঃ
"اللَّهُمَّرَبَّالسَّمَاوَاتِالسَّبْعِوَمَاأَظْلَلْنَ،وَرَبَّالْأَرَضِينَوَمَاأَقْلَلْنَ،وَرَبَّالشَّيَاطِينَوَمَاأَضْلَلْنَ،وَرَبَّالرِّيَاحِوَمَاذَرَيْنَ،فَإِنَّانَسْأَلُكَخَيْرَهَذِهِالْقَرْيَةِوَخَيْرَأَهْلِهَا،وَنَعُوذُبِكَمِنْشَرِّهَا،وَشَرِّأَهْلِهَا،وَشَرِّمَافِيهَا".

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা রাব্বাস সামাওয়াতিস সাব‘য়ি ওয়ামা আযলাল্না, ওয়া রাব্বাল আরাদীনা ওয়ামা আক্বলালনা, ওয়া রাব্বাশ শায়াতীনা ওয়ামা আদলালনা, ওয়া রাব্বার রিয়াহি ওয়ামা যারাইনা, ফাইন্না নাসআলুকা খাইরা হাযিহিল ক্বারিয়াতি ওয়া খাইরা আহলিহা, ওয়া নাউযুবিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি আহলিহা ওয়া শাররি মা ফীহা।
অর্থাৎ: “হে আল্লাহ, সাত আসমান ও তার নীচের সবকিছুর মালিক, জমিনসমূহ ও তার উপরের সবকিছুর মালিক, বাতাস ও বাতাসতাড়িত সবকিছুর মালিক। আমি আপনার কাছে এই জনপদের কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আর আমি আপনার কাছে এই জনপদের অকল্যাণ, এর অধিবাসীদের অকল্যাণ এবং এর মধ্যে যত অকল্যাণ ও অমঙ্গল আছে সবকিছু থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”( )
- কোথাও থামলে বা অবতরণ করলে হাদীসে বর্ণিত নিচের দু‘আ পড়া:
أَعُوْذُبِكَلِمَاتِاللهِالتَّامَّاتِمِنْشَرِّمَاخَلَقَ

উচ্চারণ: আউযুবিকালিমাতিল্লাহিত-তাম¥াতি মিন র্শারি মা খালাক্বা।
অর্থাৎ:“আমি আল্লাহর সৃষ্ট সবকিছুর অকল্যাণ থেকে আল্লাহর পরিপুর্ণ বাণীসমুহের আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এই দু‘আটি পড়বে সে ওই স্থান থেকে প্রস্থান করা পর্যন্ত তার কোনো ক্ষতি হবে না।”( )

হজ্জের সফরের শুরুতে প্রচলিত ভুল
আমাদের দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে হাজী সাহেবের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছে সালাম পৌঁছানোর প্রথা প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, রাসূলুল্লাহ (সা:)বলেছেন,আল্লাহ তা‘আলাআমার উম্মতের সালাম পৌঁছানোর জন্য একদল ফেরেস্তা নিয়োজিত করে রেখেছেন।( )আপনি কি আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত ফেরেস্তার উপর আস্থাশীল নন? না কি আপনি বিশেষ সালাম পাঠাতে চান? আল্লাহ তা‘আলা তো বিশেষ বাহিনী নিয়োজিত করে রেখেছেন, কোন ব্যক্তি এর চেয়ে উত্তম হতে পারেনা। আপনি যাকে দিয়ে সালাম পাঠাচ্ছেন, আল্লাহ তা‘আলা না করুন সে ভুলে যেতে পারে বা মারাও যেতে পারে, তখন আপনার সালামের কি অবস্থা হবে?

দ্বিতীয়ত সফরের শেষে
- সফর শেষে বিনা কারণে দেরী না করা।
- উপরোল্লেখিত আদবগুলি সফর থেকে ফেরার সময়ও পালন করা।
- রাসূলুল্লাহ (সা:) কোন সফর থেকে ফেরার পথে কোন উঁচুস্থানে উঠলে তিনবার "اللهأكبر")আল্লাহু আকবার( বলার পর বলতেন:
لَاإِلَهَإِلَّااللهُوَحْدَهُلَاشَرِيكَلَهُ،لَهُالْمُلْكُوَلَهُالْحَمْدُوَهُوَعَلَىكُلِّشَيْءٍقَدِيرٌ،آيِبُونَتَائِبُونَعَابِدُونَسَاجِدُونَلِرَبِّنَاحَامِدُونَ،صَدَقَاللهُوَعْدَهُ،وَنَصَرَعَبْدَهُ،وَهَزَمَالْأَحْزَابَوَحْدَهُ

উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু, ওয়া লাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইইন ক্বাদির,আ-য়িবূনা তা-য়িবূনা আ-বিদূনা সা-জিদূনা লিরাব্বিনা হামিদূনা, ছাদাকাল্লাহু ওয়া’দাহু, ওয়া নাছারা ‘আবদাহু,ওয়াহাযামাল আহযাবা ওয়াহদাহু।
অর্থাৎ: “আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি এক, তার কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসা তাঁরই, এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। আমরা প্রত্যাবর্তন করছি, তাওবা করছি, আমাদের রবের ইবাদত করছি, সিজদা করছি, এবং প্রশংসা করছি। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সম্মিলিত শক্তিকে একাই পরাজিত করেছেন।”( )
- সফর থেকে রাতে বাড়িতে না ফেরা, কারণ রাসূলুল্লাহ (সা:) তা নিষেধ করেছেন।( ) প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যদের আগেই খবর দিয়ে রাতে ফেরা যেতে পারে।
- পরিবারের সদস্যদের সালাম দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করা, তাদেরকে সঙ্গদান করা।
হজ্জের সফর থেকে ফেরার পর কিছু প্রচলিত ভুল
আমাদের দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে হজ্জ থেকে ফিরে আসার পর ৪০ দিন অন্য কারো ঘরে না যাওয়ার প্রথা চালু আছে। এমনকি এধারণাও করা হয়, কারো ঘরে গেলে হজ্জ কবুল হবে না, এধরনের ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত।

No comments:

Post a Comment