ধর্ম যেন ভূতের ভয়
মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান : ভূতের অস্তিত্ব নেই। থাকলে কারো না কারো চোখে পড়তো। কিন্তু
কোনো লোকের কাছে তো শোনা গেল না ভূত দেখার কথা। এমনকি ইতিহাসের পাতাতেও ভূত
অনুপস্থিত। ভূতের খবর পাওয়া যায়, ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য লেখা ‘ভূতের গল্প’ বইয়ে। কিন্তু বুদ্ধিমান বয়স্ক লোকে কি ভূতে বিশ্বাস রাখে? রাখে না। তবে বর্তমান যামানায় একদল লোকের কাছে ধর্ম যেন ভূতের ভয়। তাই ধর্মকে
উৎখাত করার জন্য পাশ্চাত্যের বহু জ্ঞানী-বিজ্ঞানী বহু গবেষণা করেছেন। কার্লমার্ক্স
ধর্মকে আফিমের সংগে তুলনা করেছেন। যারা আফিম সেবী তারা নেশাগ্রস্ত হয়।
নেশাগ্রস্তরা কান্ডাকান্ড হারিয়ে ফেলে। তাই তিনি ধর্মহীন তন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, যার নাম সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের ইংরেজী প্রতি শব্দ Socialism (স্যোসালিজম)। এর ভিত্তি হলো, সেক্যুলারিজম, মানে ধর্মনিরপেক্ষতা।
ধর্ম যারা মানে, অর্থাৎ- ধর্মকে মানুষের অবশ্য আচরণীয় মনে করে, তাদের বিশ্বাস, এই বিশ্ব এবং তার সকল কিছুর একজন স্রষ্টা রয়েছেন। ধর্মীয় মত
পার্থক্যের জন্য স্রষ্টাকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। মুসলমান ডাকে আল্লাহ নামে, হিন্দুরা ভগবান কিংবা ঈশ্বর বলে, খ্রীস্টানেরা বলে God (গড)। মানুষ যেহেতু আল্লাহর সৃষ্টি সেহেতু মানুষকে আল্লাহর
প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। ইসলামের আসমানী কিতাব আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইন্সা ইল্লা লিয়া’বুদূন”। অর্থাৎ- আমি জ্বিন এবং ইনসানকে (মানুষ) আমার
ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাই মুসলমানকে অবশ্যই আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। ইবাদত
মুসলমানদের জন্য ফরয (অবশ্য কর্তব্য)।
হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ গীতায় শ্রীকৃষ্ণও বলেন-
তমেব শরণং গচ্ছ
সর্বভাবেন ভারত।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং
শান্তিং স্থানং প্রাপ্যসি শাশ্বতম॥। – ১৮:৬২।
(হে ভারত, সর্বতোভাবে তাহারই স্বরণ লও, তাহার প্রসাদে পরম শান্তি ও নিত্যস্থান প্রাপ্ত হইবে)।
খ্রীস্টধর্ম বলে- God is love (গড ইজ লাভ)। এর গুঢ় অর্থ হলো, প্রভুকে ভালোবাসো। এই ভালোবাসার মানেই তার আদেশ নিষেধ মেনে চলা। অতএব, ধর্মের মূলে একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব সকল ধর্মই স্বীকার করে। আর, ধর্ম মানুষকে পাপ ও পতন থেকে রক্ষা করে। এটাও সকল ধর্মাশ্রয়ী মানুষ স্বীকার
করে। কেননা, সকল ধর্মের ধর্মগ্রন্থ পাপ পুণ্যকে চিহ্নত করেছে। ‘কী করলে কী ফল পাবে’ তাও ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে।
পাশ্চাত্যের কতিপয়
ধর্মহীন বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক উঠে পড়ে গবেষণায় লেগে গেলেন, স্রষ্টার অস্তিত্ব বিলুপ্তির জন্য। চার্লস ডারউইন নামের এক পাশ্চাত্য দেশীয়
বিজ্ঞানী Theory of
evolution (থিয়োরী অব ইভলিউশন) বা বিবর্তনবাদ আবিষ্কার
করলেন। এই থিয়োরীতে তিনি প্রমাণ করলেন, পৃথিবীর মানুষসহ সকল কিছুই বিবর্তনবাদের ফসল। এর পেছনে অদৃশ্য কোনো
সৃষ্টিকর্তার হাত নেই। চতুর প্রকৃতির বুদ্ধিমানেরা এই থিয়োরী মেনে নিলেন। এই সকল
দর্শন বিজ্ঞান যখন দেশে দেশে উচ্চ শিক্ষায় তালিকা ভুক্ত হলো, তখন থেকে শিক্ষার্থীদেরও চিন্তায় বিবর্তন এসে গেল। মানুষের কোনো সৃষ্টিকর্তা
না থাকলে তো অনেক সুবিধা। ধর্ম কর্মেরও অবশ্যক হয় না। ধর্ম না থাকলে অজাচার
স্বেচ্ছাচার ঠেকায় কে? অতএব, এই মতবাদটাই গ্রহণযোগ্য। এতে অনেক সুবিধা।
আমাদের দেশের
অশিক্ষিত অবশ্য স্বশিক্ষিত আরজ আলী মাতুব্বরও বস্তুবাদি তথা একধরণের যুক্তিবাদী
দর্শনের খপ্পরে পড়ে গেলেন। তিনি একে একে ১৮ খানা দর্শনাশ্রয়ী গ্রন্থ রচনা করে
ফেললেন। তন্মধ্যে সৃষ্টি রহস্য, সত্যের সন্ধান, অনুমান পুস্তক ইত্যাদি প্রধান। ইনি অবশ্য পাশ্চাত্য পন্ডিতদের থেকে ভিন্ন
রাস্তায় তার মতবাদকে নিয়ে গেছেন। উদাহরণতঃ তার গ্রন্থের কয়েকটি প্রশ্ন তুলে ধরছি।
(১) আল্লাহ যদি
সর্বশক্তিমান হন, তাহলে দুনিয়ার শাসনকর্তাদের মতো তাঁর আমলার (ফেরেশতা)
প্রয়োজন কেন?
(২) ভাল কাজ করায় আল্লাহ, মন্দ কাজ করায় শয়তানে। আল্লাহ কেন তা ফিরায় না। আল্লাহর ক্ষমতা বেশী, না শয়তানের ক্ষমতা বেশী?
(৩) আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া নাকি একটা ধূলিকণাও
নড়ে না, তাহলে কী করে জারয সন্তানের জন্ম হয়?
এই সকল প্রশ্নই
আমাদের বুঝতে সক্ষম করে যে, আরজ আলী মাতুব্বর আল্লাহ এবং তার ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী।
তার ইচ্ছাক্রমে তার মৃতদেহ জানাযা এবং দাফন না করে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে দান
করা হয়। আরজ আলী মাতুব্বর নামে মুসলমান হলেও, তিনি ধর্মহীন নাস্তিক। তবে আমাদের কথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহলে তার
গ্রন্থাবলীর খুব কদর আছে।
কার্লমাক্স এর
সেক্যুলার থিওরী অনুসারে প্রতিষ্ঠিত প্রথম রাষ্ট্র রাশিয়া। সেক্যুলার
রাষ্ট্র-নীতিকে বলা হয়, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর ধারক বাহকেরা কম্যুনিস্ট।
কম্যুনিস্ট মানে সাম্যবাদী। এদের নীতি মতবাদ সমালোচনার ঊর্ধ্বে। বলা যায়, শাসক গোষ্ঠীর বাইরের কারো বাক স্বাধীনতা থাকে না। এ ধারায় চলে এক নায়কত্বের
স্বৈরতন্ত্র। এই তন্ত্রে সবার জন্য কাজ এবং খাদ্যের ব্যবস্থা থাকে। সম্পদের
ব্যক্তি মালিকানা এ তন্ত্রে স্বীকৃত নয়। ধর্ম তো একেবারেই অনুপস্থিত। যারা ধর্ম
মানে, তাদের কাছে ধর্মহীন মানুষ এবং মনুষ্যেতর প্রাণীর মধ্যে কোনো
পার্থক্য নেই।
বিশ্বে খুব কমই ঘোষিত
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রয়েছে। তবে কম্যুনিজম ভাবাপন্ন কিছু লোক প্রায় সকল দেশেই
আছে। ইসলামও সাম্যবাদের কথা বলে। তবে সেই সাম্যবাদ ধর্মবিহীন নয়। মার্ক্সীয়
কম্যুনিজম থেকে রাজনৈতিক কম্যুনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছে, তাতে ধর্ম অনুপস্থিত। কম্যুনিস্ট পার্টি আমাদের দেশেও আছে। গ্রামে গঞ্জে আমরা
কিছু কম্যুনিস্ট কর্মী দেখি। তাদের কেউ কেউ আমাদের ঘনিষ্টজনও। লক্ষ্য করা গেছে এরা
ধর্মীয় কোনো আচারে নেই। এ ধরণের কম্যুনিস্ট কর্মী মারা গেলে জানাযা দাফন হয়। একটু
বড় মাপের লোক হলে ২/৩ বারও জানাযা হয়। তবে আমার এক কম্যুনিস্টভাবাপন্ন হিন্দু
বন্ধুকে (সহপাঠীও) দেখেছি চলার পথে মন্দির সামনে পড়লে দু’ হাত জোড় করে কপালে ঠেকায়, অর্থাৎ- প্রণাম জানায়। ধর্মীয় অনুভূতিটা রয়েছে কম্যুনিস্ট
হবার পরেও আমার সেই হিন্দু বন্ধুর। এরূপ আরো দু’একজনকে দেখেছি। কম্যুনিস্ট মুসলমান (মার্ক্সীয়)
সেক্যুলারিজমের একনিষ্ঠ অনুসারী হয়। এটা লক্ষ্য করেছি, তারা ধর্মের ধার ধারে না। কেননা কার্লমার্ক্স বলেছেন, Religion
is the opium of the people. একশ্রেণীর প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মুসলমানও বলে থাকেনঃ ‘ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার’। আমি এ কথা মানি না। নিশ্চয় আমার মতো আরোও অনেকেই মানেন না। ধর্ম ব্যক্তিগত হলে, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি, জামায়াতে মসজিদের নামায পড়া কেন? ঈদগাহে জমায়েত হওয়া কেন? ওয়ায মাহফিল কেন? তাবলীগ জামাত কেন? বিশ্ব ইস্তেমায় যাওয়া কেন? ধর্ম ব্যক্তিগত শুধু নয়, সামজিকও। যে দেশে ধর্মীয় আইনে রাষ্ট্র শাসিত হয়, সেদেশে ধর্ম রাষ্ট্রীয় ব্যাপারও। তবে ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তার কাছে, যে ধর্ম বিধি মেনে জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত নয়। তার শুধু একটা জন্মগত ধর্মীয়
পরিচয় থাকলেও ‘ব্যক্তিগত ব্যাপারের’ কারণে সে শুধু মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। ধর্ম ব্যক্তিগত হলে কারো পরিবারের
লোকজনকেও ধর্মাচরণের তাকিদ দেওয়ার সুযোগ থাকে না। আর, যদি তাকিদ না থাকে, তাহলে সেই পরিবারে ধর্মাচারী লোক এক সময়ে আর থাকবে না। বরং
ধর্ম নিন্দুকেরই বংশ বিস্তার ঘটবে। অধূনা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ফেইসবুকে, ব্লগে, ইসলামধর্ম, ইসলামী অনুশাসন, আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ইত্যাদি নিয়ে আপত্তিকর কথা পোস্ট করা হয়। এসব
নিয়ে বইও ছাপানো হয়।
৩ নভেম্বর তারিখের
দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবরঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছির নগর উপজেলার
হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের রসরাজ দাস কর্তৃক পবিত্র কা’বা ঘরের ছবির উপর শিবমূর্তি পোস্টিং করায় ক্ষীপ্ত মুসলমানরা
হিন্দু এলাকায় কিছু অঘটন ঘটিয়েছে। যেমন- মন্দির ভেঙ্গেছে, হিন্দু বাড়ী ভাংচুর এবং লুট করেছে। উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করেছেন আইন ও সালিশ
কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামীলীগ
সভাপতি র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এম.পি। সুলতানা কামাল সুষ্ঠু তদন্ত করে এ
ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবী জানান।
এ ধরনের ঘটনা
বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বেশ কিছু কাল ধরে শুধু হিন্দুরাই নয়, মুসলমানেরা ইসলাম আবমাননায় লিপ্ত। যারা ধর্ম মানে না কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ
মতবাদে বিশ্বাসী, তাদের তো কোনো ধর্মের অবমাননা করার আবশ্যক হবার কথা নয়। যা
মানি না, কিংবা যার পক্ষে নেই, তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে দেশে নাশকতা মূলক কর্মকান্ড ঘটার পরিবেশ সৃষ্টি করার
মানে কি? এসব অপতৎপরতা বন্ধে রাষ্ট্র যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে কি?
আমি বলবো, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রক্ষার জন্য
(ধর্মের জন্য নয়) মুসলমানদের পবিত্র কা’বা ঘরে শিব মূর্তি পোস্টকারী এবং পরবর্তীতে হিন্দু এলাকায়
সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করা দায়ীদেরকে গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্ত মূলক কঠোর শাস্তি
প্রদান করা হোক, এটাই কামনা করি। নতুবা এটা যেমন কিছুকাল যাবত এদেশে চলছে, তেমনিই চলতে থাকবে। এটা বলছি এ কারণে যে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোনো ধর্মের পক্ষ নিতে চাইবে না। তা বলে কেউ কারো ধর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, সেটাও চলতে দেওয়া যায় না। তাই বলছি, উভয় পক্ষকে বিচারের আওতায় আনতে হবে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে। যারা
ধর্মের পক্ষে নেই, তাদেরও শান্তি শৃঙ্খলার আবশ্যক আছে।
আমাদের দেশে একদল
সাধু ফকির আছেন। তারা মানবধর্ম প্রচার করছে। এ ধর্মের মূল তত্ত্বঃ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। এই তত্ত্বের আলোকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
‘তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম সকল যুগবতার, তোমার হৃদয় বিশ্ব দেউল সকলের
দেবতার।
কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর
মৃতপুঁথি কঙ্কালে? হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার নিভৃত
অন্তরালে।
এই হৃদয়ই যে নীলাচল, কাশী মথুরা বৃন্দাবন, বুদ্ধগয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মসজিদ এই, মন্দির এই, গীর্জা এই হৃদয় এইখানে
বসে ঈসা মূসা পেল সত্যের
পরিচয়’।
স্বামী বিবেকানন্দের
কথাতেও এই সুর ধ্বনিত হয়, তিনি যখন বলেন-
‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি
কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীব প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।
এই মানবধর্ম মতবাদে
লালনশাহ, হাছন রাজা, যবন হরিদাসরা যা করতেন, তা ধর্ম নিয়ে একরূপ তামাশা মাত্র। সকল ধর্মই ছকে বাঁধা। তার বাইরে গেলে সেটা
আর ধর্ম থাকে না। ধর্ম তামাশা নয়। ইসলামধর্ম মতে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যসহ
তাঁর দেওয়া আদেশ নিষেধ মেনে জীবন-যাত্রা নির্বাহ করতে হবে। তাহলেই পারলৌকিক অনন্ত
জীবন পরম সুখে কাটবে। মুসলমান পরলোকে বিশ্বাসী। সকল জীবই মৃত্যুর অধীন। হিন্দু
বৌদ্ধ ধর্মে ‘জন্ম ধ্রুবং মৃতস্যচ’ থাকলেও ইসলাম বলে ‘কুল্লু নাফসিন যা ইকাতুল মাউত’ সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। যে ধর্মের লোকই হোক, আজ পর্যন্ত কাউকে দেখা যায়নি কিংবা কারো কাছে শোনা যায়নি যে, সে একবার মরে আবার পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছেন। মুসলমান আল্লাহর কিতাব আল কুরআনে
অটল বিশ্বাসী। তাই তারা কোনো ভ্রান্ত আকিদায় কান দেয় না। যারা দেয়, তারা খাঁটি নয় বরং ভেজাল মুসলমান।
ইসলাম ধর্মমতে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ বলে কোনো কথা নেই। একথা যুক্তিহীন। কারণ, আল্লাহর সৃষ্ট জগতে যা কিছু আছে, সবই সত্য। সবকিছুই তার সৃষ্ট মাখলুকাতের অন্তর্ভুক্ত। তবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব
হলো মানুষ। তাই তার মর্যাদা সর্বাধিক। তাকে বলা হয়েছে আশরাফুল মাখলুকাত। আর মানুষ
যেহেতু আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি, তাই জীবের প্রতি প্রেম থাকলে তিনি খুশি হন। প্রেম বা ভালোবাসা
আল্লাহর প্রতিও থাকতে হবে এবং সৃষ্টির প্রতিও থাকতে হবে। ভালোবাসা থাকলেই খিদমতে
খালক্ব সম্ভব। নতুবা তা সম্ভবপর হয় না। প্রেম বিষয়ে দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালের
উক্তি- love is
the first teacher of intellect and vision. if there is no love, religion becomes
a mere temple of imaginations (লাভ ইজ দা ফার্স্ট টিচার অব ইনটেলেকট এ্যন্ড ভিসন। ইফ দেয়ার ইজ নো লাভ, রিলিজন বিকাম্স্ এ মিয়ার টেম্পল অব ইমাজিনেশন্স্)।
হ্যাঁ, প্রেম থাকতে হবে একনিষ্ঠ। প্রথমে আল্লাহর প্রতি, অতঃপর আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি। আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁর সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা
মূল্যহীন। তা যদি হয়, তাহলে মনে করতে হবে যে, সৃষ্টির চাইতে Belief in god is the ultimate
confession of all the faiths of the world. (বিলিফ ইন গড ইজ দ্যা আলটিমেট কনফেশন অব অল দ্যা ফেইস অব
দ্যা ওয়ার্ল্ড)।
ধর্মসমূহের মধ্যে
ইসলামকেই সবাই ভয় পায়। ইসলামধর্ম সব ব্যাপারেই বড় কঠোর। এ ধর্মে মদ্যপানের অনুমতি
নেই, সুদের অনুমতি নেই, নারী-পুরুষের লিভটুগেদার এবং জাতে-বেজাতে বিয়ে সমর্থন করে না। ইসলামী অনুশাসনে
নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা মহাপাপ। ইসলামের রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ
করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অশান্তি ও
বিবাদ সৃষ্টি করে, সে বেহেস্তে যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, (১) যে ব্যক্তি যে কওমের অনুসরণ করে, সে তাদের অন্তর্ভূক্ত। (২) যে ঘরে ছবি থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না।
ইসলামের বিচার
ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর। রাজপুত্রও বিচারিক দন্ড থেকে অব্যাহতি পায় না। হযরত ওমর
(রাযি.)এর অতীত যুগের কথা বলবো না। সাম্প্রতিককালে এক সৌদি প্রিন্সকে বিচারে
প্রাণদন্ড দেওয়া হয়েছে। ইসলামে জবাবদিহিতা বিহীন এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ার, কারাগারে হার্টএ্যাটাক জাতীয় মৃত্যুর কোনো সুযোগ নেই। সঠিক সাক্ষীর সাক্ষ্য
প্রমাণে ইসলামী ফাতাওয়া ভিত্তিক ইনসাফ করার সুযোগ ইসলামে রয়েছে। এই কঠোরতা এবং
ন্যায় নিষ্ঠার কারণেই ইসলামকে ভয়, যেন ভূতের ভয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার নামে
ইসলাম ও মুসলমানের অবমাননা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। ইসলামের মহানবী (সা.)কে কটূক্তি করে
কুরআনের বিধানকে অবমাননা করে ইন্টারনেটে ও প্রিন্ট মিডিয়ায় লেখা হচ্ছে। লিখছে
হিন্দু, ইহুদী, খ্রীস্টান, বৌদ্ধরাই শুধু নয়, বাংলাদেশের কিছু নামধারী কথিত মুসলমানও তাতে অংশ নিচ্ছে। জঙ্গী মুসলমান কি
অমনি বলা হয়। মতলব বাজেরা একফোটা গুড় চৌকাঠে লাগিয়ে রাখতে পারলে যে মাছির উপর
উপদ্রব হয়, তা দমন করতে কামান দাগার আবশ্যক হয়ে পড়ে। তারপরের অবস্থা
আশাকরি, অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। এই যে কর্মটি তা শুধু ইসলামকে
নিয়েই হচ্ছে। কই যীশুকে নিয়ে তো কেউ কটূক্তি করে না, কটূক্তি করে না শ্রী-রামচন্দ্র কিংবা শ্রী-কৃষ্ণকে নিয়েও। তবে ইসলাম, ইসলামের মহানবী (সা.) এবং ইসলামী অনুশাসন নিয়ে কেন এতো বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োগ করা হচ্ছে? তবে এ কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মনোকষ্ট হওয়া খুবই স্বাভাবিক, তবে উগ্র হবার কোনো কারণ নেই। যারা এ ব্যাপারে উগ্রমূর্তি ধারণ করে কোনো
নাশকতা মূলক কর্মে লিপ্ত হয়, তারা ইসলামপ্রিয় মুসলমান নয়। রাসূল (সা.)এর হাদীসে শেষ
সিদ্ধান্ত দেওয়া আছে, ‘মুখে অন্যায়ের
প্রতিবাদ করার পরিবেশ না থাকলে, মনে মনে ঘৃণা পোষণ করো’। অতএব, ধৈর্য্য ধারণ করো। তাহলে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। ইসলাম
শান্তির ধর্ম, ইসলাম শান্তি চায়। প্রকৃতই ইসলামে ইনসাফ আছে; ভূতের ভয় নেই।
No comments:
Post a Comment