Wednesday, 15 March 2017

রোহিঙ্গা ইস্যু : মানবিক না ধর্মীয় এ বিতর্ক কেন?

রোহিঙ্গা ইস্যু : মানবিক না ধর্মীয় এ বিতর্ক কেন?
আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নির্যাতন  নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। শান্তির বাণীর শ্লোগানধারীবৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সূচীর সরকারী বাহিনী সিনাজুরিও দেখিয়ে চলেছেন।আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তারা নিজেরা তদন্ত করে আরাকানে কোনো নির্যাতন হয়নি বলে প্রতিবেদনও প্রকাশকরে দিয়েছেন।  যেন পুলিশের মামলা পুলিশকে দিয়ে তদন্ত করানো।
আজকের আলোচনা সে প্রসঙ্গে নয়। আজ ভিন্ন একটি বিষয়ে বলতে চাই। রোহিঙ্গাদের ওপর গত বছরেরশেষের দিকে নির্যাতন শুরু হওয়ার পর সাধারণ ধারার বাইরে গিয়ে অনেক লেখক সংবাদিক, আইনজীবী ভাই-বোনও  নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন-আওয়াজ তুলেছেন। আমরা তাদের সাধুবাদ জানাতে চাই।স্বদেশ-বিদেশের যে কোনো অন্যায়-অপরাধে তারা এভাবে সোচ্চার হলে জাতি উপকৃত হবে। কিন্তু তাদেরঅনেকের লেখায়  কথায় একটি বিষয় উঠে এসেছে, তা হল রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তারা বলছেন মানবিকবিবেচনায়, ধর্মীয় বিবেচনায় নয়।  বাক্যে দোষ ছিল না যদি  ব্যক্তিগণ ইসলাম ধর্মাবলম্বী না হতেন। কিন্তুএকজন মুসলমানের জন্য এমন মন্তব্য কিছুতেই মানানসই নয়। কারণ ইসলাম এমন কোনো ধর্ম নয়, যাতেমানবিকতার কমতি আছে; বরং ইসলাম এসেছেই পূর্ণ মানব হওয়ার দাওয়াত নিয়ে, একজন বনী আদমকীভাবে পশুত্বের সকল দোষ ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে ইসলাম সে শিক্ষাগুলোইপ্রদান করে। কথায় এবং শক্তি দিয়ে কারো নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটালে সে মুসলমানই হতে পারে না।মানুষজনকে কষ্ট-ক্লেশে ফেললে সে কিসের মুমিন। ইসলামের নবী সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম  কথাগুলোই বলে গেছেন। এক বিখ্যাত হাদীসে তিনি বলেছেন-
المؤمن من أمنه الناس
মুমিন সে, যার ব্যাপারে লোকেরা নিরাপদ থাকে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৯৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৫৬১
বিক্ষুব্ধ অনিরাপদ বিশ্বে তিনি শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন আরো দেড় হাজার বছর আগে। গোষ্ঠী-গোত্রের দ্বন্দেহানাহানি-মারামারিতে লিপ্ত লোকগুলোকে মানবিকতার সকল গুণে গুণান্বিত করে গড়ে তুলেছিলেন স্বর্ণমানবহিসেবে। তারই প্রভাবে মুসলমানগণ হাজার বছর যাবৎ ইনসাফের রাজত্ব করেছেন পৃথিবীতে। নববী যুগেরপর কয়েক শতাব্দী ব্যাপী সময়টি খাইরুল কুরুন তথা স্বর্ণযুগ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে  শ্রেষ্ঠ মানবদেরকারণেই, যারা ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত  ঈমানগুণে গুণান্বিত হয়ে নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছিলেনমানবিকতার সকল গুণ।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ঘোষণা তো এসেছে মাত্র গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে। সে থেকে  দশক পারহলেও শান্তি আসেনি পৃথিবীতে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সমানাধিকার, এই স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতা- কতশ্লোগান, কত শ্রম্নতিমধুর নাম শুনল বিশ্ববাসী। কিন্তু মানুষ পেল না তার মানবিক অধিকারগুলো। তাহলেবর্তমান বিশ্ব নিয়ে যারা চিন্তা করেন তাদের কি একবার ভেবে দেখা দরকার নয় যে,  কারণটি কী ছিল, যারমাধ্যমে ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তির বিপস্নব ঘটিয়ে ফেললেন অল্প কয় বছরে। আরএখন কী নেই, যার কারণে সফলতা আসছে না। আজ সে বিষয়টি থাক। আমরা যে কথা বলছিলাম অর্থাৎ কর্মও মানবিকতা একজন মুসলমান নিজ ধর্ম নিয়ে যথাযথভাবে পড়াশুনা করলেই জানতে পারবে, ইসলাম যেমানবিকতা শিখিয়েছে এবং বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে তার নজির না কেউ আগে আনতে পেরেছে, না এর চেয়েভাল কোনো পথ  আদর্শ দেখানো সম্ভব। ইসলামে মানবাধিকারের সূত্র  মূলনীতিগুলো আলোচনার জন্য  তোদীর্ঘ পরিসর দরকার, এখানে নমুনা স্বরূপ দু-একটি মূলনীতি পেশ করা হল।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
یۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّ اُنْثٰی وَ جَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًا وَّ قَبَآىِٕلَ لِتَعَارَفُوْا اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقٰىكُمْ   اِنَّ اللهَ عَلِیْمٌ خَبِیْرٌ.
হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ  এক নারী হতে। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্নজাতি  গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেইঅধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছু জানেন; সমস্ত খবররাখেন। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১৩
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَلَا إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ، وَإِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ، أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ، وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلَا أَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، إِلَّا بِالتَّقْوَى.
হে মানুষ! সাবধান তোমাদের রব একজন, তোমাদের বাবাও একজন। সাবধান! কোনো আরবীর শ্রেষ্ঠত্ব নেইআজমীর উপর; আর না কোনো আজমীর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে আরবীর উপর। না লালবর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব কালো বর্ণেরউপর, আর না কালো বর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব লালবর্ণের উপর। শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার দ্বারা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস২৩৪৮৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস  ৪৭৭৪
তাহলে একজন মুসলমান ধর্ম  মানবিকতাকে আলাদা করতে পারে কীভাবে। সে তো বলবে মানুষ যা কিছুকেমানবিকতা ভাবে ইসলাম এর চেয়েও ভালো  সুন্দর মানবিক গুণাবলীর সবক দিয়েছে।
আরেকটি কথা হল- একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের দুঃখে দুঃখী হওয়া এবং ন্যায়ের ক্ষেত্রে তার পক্ষে কথাবলা কি সাম্প্রদায়িকতা বা দোষের কিছু। হাতে গোনা তথাকথিত অতি ভদ্র কিছু মুসলিম নেতা, লেখক, বুদ্ধিজীবী ছাড়া অন্য ধর্মের লোকেরা কি তাদের ধর্মের লোকদের পক্ষে কথা বলতে, কাজ করতে কোনোসংকোচ বা লজ্জাবোধ করে? এই যে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি, সংবিধানের দিক থেকে যা সম্পূর্ণ সেক্যুলার, যেখানে আইনের বিচারে কোনো ধর্মের প্রাধান্য নেই; কার্যক্ষেত্রে বাস্তবতা যদিও ভিন্ন- সে দেশের সরকারও তোবিশ্বের কোথাও হিন্দুদের কিছু হলে গর্জে ওঠে। আশপাশের দেশগুলোর হিন্দুদের  দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসেরসুযোগ করে দেয়,  নিয়ে তারা তো কোনো রাখঢাক করে না। কিন্তু আমরা নিজ ধর্মের নির্যাতিত লোকদেরপক্ষে বলতে গিয়ে লজ্জায় মাথা নত করে ফেলি; পাছে কে কী বলে সেই ভয়ে আগেই বলে দেই- আমি মানবিকদৃষ্টিতে বলছি; ধর্মীয় বিবেচনায় নয়!
আচ্ছা অত্যাচারী বর্মী হায়েনারা কি সেখানে মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মের কাউকে নিপীড়ন করছে? রোহিঙ্গাজনগোষ্ঠী তো মুসলিম হওয়ার কারণেই নিপীড়িত হচ্ছে।
সবশেষে আমরা দেশের সকল মুসলমানদের মানবিকতা  ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার এবংসম্ভাব্য সকল উপায়ে তাদের পাশে দাঁড়াবার আহক্ষান জানাচ্ছি। সম্ভব হলে তাদের দেশেও সাহায্য পৌঁছানোকর্তব্য। আর সহায্য-সহযোগিতা তাদের হাতে যেন পৌঁছে সে ব্যপারে সতর্ক থাকাও কর্তব্য।


No comments:

Post a Comment